ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

আমার বাতিঘর: ক্ষণজন্মা আত্মত্যাগী এক মহান পুরুষ

(চরমভাবে বখে যাওয়া ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া একজন কিশোরের জীবনবোধে ফিরে আসার সত্য কাহিনী)

বন্ধুদের সাথে হাউজি খেলে যখন বাসায় ফিরেছি তখন রাত দুটো। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।নোয়াভাইকে সামনে বসা দেখে আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। এ সময়ে নোয়াভাইয়ের জেগে থাকার কথা নয়। নোয়াভাই ধীরে ধীরে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। খুবই ধীর-স্থির, শান্তভাবে বললেন, “ও, তুমি এসে গেছ! হাত-মুখ ধুয়ে এসো, একসাথে খাই। তোমার সাথে খাব বলে অপেক্ষা করছিলাম। অনেক রাত হওয়াতে বেশ টায়ার্ড লাগছে। ভোরে উঠে আবার ছাত্র পড়িয়ে অফিসে যেতে হবে।”

মা নোয়াভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “ওরে ঐরম নরম কতা কলি অবি! এতে তো ওর আরও বাইড় বাড়বি। ধরে আচ্ছামতন ছেঁচা দেও। জানোয়ার কুহানের। হাঁড় মাংস জ্বালায় খালো।”

হাত-মুখ ধুয়ে ভয়ে ভয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, বসার সাহস হচ্ছে না। নোয়াভাই শান্তভাবে বললেন, “কি হল, বস।” আমি খুব সন্তর্পণে বসলাম। নোয়াভাই প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজের হাতে আমায় ভাত তুলে দিলেন, তরকারী তুলে দিলেন। বললেন, “খাও।”

আমার যে কি অবস্থা তা বলতে পারবো না। মনে হচ্ছে ঘরের মেঝে ফাঁক হলে আমি তার ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেই। আমি বসেই আছি। প্লেটে হাত দেওয়ার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছি। নোয়াভাই বললেন, “টায়ার্ড লাগছে? আমি মাখিয়ে খাইয়ে দেই?” আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ভাতে হাত দিলাম। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, খাব কি!

নোয়াভাই বললেন, “তোমাদের সাথে বসেই আমার খাওয়া উচিৎ। সব সময়ে না পারলেও এ্যটলিস্ট রাত্রের খাবারটা একসাথে খাওয়া উচিৎ। এ প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝলেও সময়টা ঠিক বের করতে পারি না, ব্যস্ত থাকিতো। ভাবছি এখন থেকে রাত্রে তোমাদের সাথেই খাব। আমি এটা এনজয় করি। তাছাড়া গার্জিয়ান হিসেবে এটা আমার দায়িত্বও বটে। তোমাদের সাথে একসাথে খেতে বসতে পারি না, গার্জিয়ান হিসেবে এটা আমার ব্যর্থতা। আমার এ ব্যর্থতাকে আশা করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে।” আমি নিশ্চুপ। আমার হাত-পা কাঁপছে।

নোয়াভাই বলতে থাকলেন, “শুনলাম, আজ হাউজিতে অনেক টাকা জিতেছ। খুবই ভাল কথা। জীবনে বিজয়ের প্রয়োজন আছে। বিজয়ের জন্যই মানুষ তার সারাটা জীবন লড়ে যায়। যে বিজয়ী হতে চায় না, তার জন্য তো জীবন নয়। তুমি বিজয়ী হতে চাও, জীবন তোমার জন্য এবং তোমার মতো আরও যারা আছে তাদের জন্য। কিন্তু সব বিজয়ই কি কাঙিক্ষত? সব বিজয়ই কি কাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিৎ? অথবা যেটিকে বিজয় বলে ভাবছ, সেটি কি আসলে বিজয়? এ বিবেচনাবোধও থাকা দরকার।” একটু থেমে আবার বলতে থাকলেন-

“কাল সকালে তুমি যখন বাসা থেকে বের হবে তখন তোমার বন্ধুরা সবাই তোমার এ বিজয়ের জন্য তোমাকে বাহবা দেবে। মিষ্টি খেতে চাইবে। তোমার খুব ভাল লাগবে, লাগারই কথা, না লাগারতো কোন কারণ নাই। তুমি কি মনে করো হাউজিতে টাকা জিতে তার বিনিময়ে এ বাহবা আসলেই তোমার আত্মসম্মান বাড়াবে? আমি কিছু বলছি না, তুমি নিজের কাছে নিজে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। আমি জানি তুমি অবিবেচক নও। তুমি তোমার নিজের কাছ থেকেই সঠিক উত্তরটা পেয়ে যাবে আশাকরি।”

আমি নিঃশ্চুপ। খাওয়াও ভুলে গেছি। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ভাতের প্লেটে পানি পড়ছে। নোয়াভাই বললেন, “খাচ্ছ না কেন? খাও। সময়ের অভাবে তোমার সাথে গল্প করা হয় না। আজ মনে হল একটু গল্প করি। এখন থেকে মাঝে-মধ্যেই তোমার সাথে গল্প করার জন্য সময় বের করব। আশা করি তুমি সে সময়টা আমাকে দেবে। তুমি অনেক ব্যস্ত থাকো। তোমার অনেক কাজ, তারপরেও চেষ্টা করো আমাকে সময়টা দিতে।”

আমি পাথরের মতো বসে শুনে যাচ্ছি। শরীর চুলকালেও নড়তে পারছি না। আমার নৈতিক অধপতন নোয়াভাইয়ের মতো হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের সামনে আমাকে এতোটাই ক্ষুদ্র করে ফেলেছে যে আমার নড়ার শক্তিটুকু লোপ পেয়ে গেছে। নোয়াভাই আবার বলতে শুরু করলেন-

“ছয় নম্বর রোডের মাথায় একটা পরিবার এসেছে। ওদের বাসায় একটা মেয়ের সাথে তোমার বোধ হয় একটু জানাশোনা আছে। মেয়েটির একটা ছোট বোন বোধ হয় এ বিষয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করে। তোমার বয়স বিবেচনায় তোমার জন্য এ সম্পর্কটি নিতান্তই কৌতূহলের। এ বয়সে এমনটি হতেই পারে, এটিই স্বাভাবিক। ঐ বয়সে আমারও হয়েছিল, সবারই হয়। মানব জীবনের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এটিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে অতিক্রম করাটাই প্রত্যাশিত। ফলে এ ধরণের কৌতূহল ত্যাগ করাটাই বুদ্ধীদিপ্ততার পরিচয়।”

“এখন যে সম্পর্কটিকে তোমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে সেটি আসলে বাস্তবতা সম্পর্কে তোমার এক্সপোজার কম থাকার কারণে। আগে বাস্তবতাকে জানার জন্য তোমাকে সময় দিতে হবে তারপরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব জানার পরেও তুমি যদি মনে করো তোমার এখনকার সিদ্ধান্ত তখনকার জন্যেও সঠিক, তবে তুমি তখনও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারবে। কোন অসুবিধাতো নাই। তবে সে সময় এখনও আসেনি। সে জন্য নিজেকে গড়ার প্রয়োজন আছে আর এ জন্য এখন তোমাকে সময় দিতে হবে। আশাকরি তুমি নিজের জন্য সে সময় দেবে।”

“যোগ্যতা ও প্রত্যাশা থাকার পরেও সুযোগের অভাবে আমি নিজে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারিনি। তোমার মাধ্যমে আমি সেগুলির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমি প্রত্যাশা করি তুমি আমার সে না পাওয়া প্রত্যাশাগুলি পূরণ করতে সমর্থ হবে। সেটি চাইলেই হবে না, সে জন্য চেষ্টা ও সাধনা করা প্রয়োজন। আশা করি তুমি তা করবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য তোমার যে কোন প্রয়োজনেই আমি তোমার সাথে আছি।” নোয়াভাই থামলেন। খানিকটা থেমে আবার বললেন-

“তুমি সিগারেট খাও। খবর নিয়ে জানলাম যে ব্রান্ডের সিগারেট তুমি খাও তা খুব সস্তা ব্রান্ড। কামাল, তাজু, লাভলু, বাবু, লিটু এদের সাথেই সারাক্ষণ থাক, সিগারেট খাও, আড্ডা দাও। আরও অনেক কিছুই করো বলে জেনেছি। সেগুলি বললে তোমার আরো বেশি খারাপ লাগবে বলে বলছি না, তবে আমি বিষয়গুলি জানি। ওদের সাথে মিশেও যে তুমি সম্পূর্ণ ওদের মতো হতে পারোনি, কিছুটা ভিন্নতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ বজায় রাখ সেটাও আমি জানি।”

“সিগারেট খেতে ভাল লাগলে খাবে, অসুবিধাতো নেই। তবে দামী সিগারেট খাবে। সস্তা সিগারেট খাবে না। এতে অবশ্যই বেশি টাকা লাগবে, সে জন্য চিন্তা করো না, টাকা আমি দেব। আমার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেবে। যদি টাকা চেয়ে নিতে লজ্জা পাও, তবে আমার পকেট থেকে নিয়ে নেবে। আমার পকেটে সব সময়ে টাকা থাকে। তোমার প্রয়োজন মেটানো আমার দায়িত্ব। প্রতিটি গার্জিয়ানেরই দায়িত্ব তার ডিপেন্ডেন্টদের প্রয়োজন মেটানো। তোমার সিগারেটের প্রয়োজন মেটানোও আমার দায়িত্ব।

আমি সিগারেট খাই না, কারণ এটি খেতে আমার ভালো লাগে না। সিগারেট খাওয়াটাকে আমি কোন প্রয়োজন বলেও মনে করি না। সেটা আমার রুচিবোধ। আমি যা ভাবি তোমাকে যে তাই-ই ভাবতে হবে এমনতো কোন কথা নেই। তোমার ভালো লাগলে তুমি খাবে, কোন অসুবিধা তো নাই। তবে আমি তোমাকে এটুকুই বলছি- তুমি জীবনে যেখানে যাবে, সেখানের লোকেরা সস্তা সিগারেট খায় না। তুমি এখন থেকেই সে চেষ্টা করো। আমি তোমাকে সহযোগিতা করব।

এ বয়সে দোকানের সামনে, রাস্তায় বসে সিগারেট খেলে মানুষ তা ভাল চোখে দেখে না। পরিবারেরও বদনাম হয়। প্রয়োজনে আমি সিগারেট কিনে এনে বাসায় রেখে দেব, তুমি সেখান থেকে নিয়ে নিয়ে খাবে। কোন অসুবিধাতো নেই, না কি? পরিবারের সম্মানের দিকটি বিবেচনা করে রাস্তায় বসে সিগারেট না খাবার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারো।”

ততক্ষণে আমি বোধ হয় সেন্স হারাতে শুরু করেছি। নিজের শ্বাস ফেলার শব্দও আমাকে আতঙ্কিত করে তুলছে।

এরপরে বললেন, “তোমার ফর্ম-ফিল-আপের বিষয়টি জেনেছি। এখন বোধ হয় আর চেষ্টা করার সময় নাই। তারপরেও পড়তে থাক। পরেরবারের জন্য কাজে লাগবে। এবারে বোধ হয় আর পারবে না। মিরাকল ঘটলে সে কথা আলাদা। আমি জানি পড়াশোনা না করলেও তুমি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি গুছিয়ে রেখেছ। যতটুকু গুছিয়ে রেখেছ তার উপরে ভিত্তি করে একটা ড্রাইভ দিতে চেষ্টা করো। যতটুকু মেধা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহারটা করতে পারলে সফল হলেও হতে পারো, যদিও আমি আর ভরসা করতে পারছি না। পুরোটাই নির্ভর করছে তোমার উপরে। আমি কি ভাবলাম সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, তোমার নিজের উপরে নিজে আস্থা স্থাপন করে এগোতে হবে। সেভাবেই চেষ্টা করো।”

অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে খুবই শান্ত মেজাজে নোয়াভাই কথাগুলো বলে গেলেন। শেষে বললেন, “অনেক রাত হয়েছে, এখন ঘুমুতে যাও। বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। যে কথাগুলি বললাম তা তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য নয়, যদিও তুমি কষ্ট পাবে। বিষয়টিকে অনুশোচনা হিসেবে নিতে পারো, তাহলে এটা তোমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করবে। কোনোকিছুই শেষ হয়ে যায়নি, সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছে মাত্র। সামনের সময়কে পরিকল্পিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে হারানো সময়কে আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসতে পারো। তুমি বুদ্ধিমান, তুমি তা পারবে। যাও, এখন ঘুমুতে যাও। ”

নোয়াভাই চলে গেলেন। আমি সেখানে বসেই থাকলাম। আমার পা নড়ছে না, আমার পুরো শরীর আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দু চোখে অশ্রু-বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আমার অপরাধবোধ আমাকে রক্তাক্ত করে আমার উপরে চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে।

এ কী করেছি আমি! নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে ঘরের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কতো রকম অপকর্ম করে বেড়াচ্ছি। মনে মনে নিজেকে হিরো ভাবছি। অথচ আমি যেখানে যা কিছুই করে বেড়াচ্ছি তার সব কিছুই নোয়াভাইয়ের পূর্ণ গোচরে, একেবারে নখদর্পণে। হাউজি খেলে বাসায় আসার আগেই নোয়াভাই সে খবর জেনে ফেলেছেন। নোয়াভাই আমার নাড়ী-নক্ষত্রের সব কিছুই জানেন। আমি আমাকে যতটা চিনি তারচেয়ে নোয়াভাই আমাকে অনেক বেশি চেনেন। নোয়াভাইয়ের মতো হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের গভীর দূর দৃষ্টি ও বিবেচনার বাইরে যাবার ক্ষমতা পরিচিত মহলের কারওই হয়নি, আমি তো সেখানে নিতান্তই শিশু।

কৈশোর বয়সের বিপথগামী একজন বখাটে কিশোরকে কিভাবে ইতিবাচক কাউন্সেলিং করে প্রত্যাশিত পথে ফেরাতে হয় তার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আমার নোয়াভাই। মনের ভিতরে আত্ম-অনুশোচনা জাগিয়ে তুলে সে অনুশোচনার তীব্রতা কেমন করে অন্তরের কালিমাকে দূর করে দিয়ে শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনে তার এক অনন্য উদাহরণ ছিল সেদিনের সে কাউন্সেলিং। পরবর্তী জীবনে আমি বহু কাউন্সেলিং ট্রেনিং করিয়েছি কিন্তু সেদিনের সে কাউন্সেলিং ছিল আমার জীবনে অনন্য।
*
১২ই জানুয়ারি ছিল আমার নোয়াভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৯ সালের এই দিনে নোয়াভাই আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলেযান। অফিস থেকে ফিরে কথা বলতে বলতে বুকে ব্যথা এবং তারপর সব শেষ। আমার নোয়াভাই সবার প্রিয় সুফিয়ান স্যার। আমার বাতিঘর, ক্ষণজন্মা এক আত্মত্যাগী মহান পুরুষ।

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 15/01/2020
সর্বমোট 593 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন