ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

আগামীর বাংলাদেশ

রাজিব তোমার হাত বাংলাদেশ।
আরে মিয়া! ওর হাতে তো ভ্যান। বললেন মাজেদ কাকা।
না, কাকা আপনি বোঝেন নাই।
হ, মিয়া তুমরাই সবকিছু বোঝো।
আমি তা বলিনি।
যা ইচ্ছা কও। এহন তুমাগো কওয়ার সময়।
রাজিব আমাদের গ্রামের ছেলে। ওর মা আমাদের বাড়িতে কাজ করতো। সেই সুবাদে ওর সাথে আমার পরিচয়। ওর মাকে আপা বলে ডাকতাম। সেই সুবাদে রাজিব আমাকে মামা বলে।
ছোটবেলা ওর মায়ের সাথে আসতো। ওর মা কাজ করতো। ও বসে থাকতো। ও প্রচুর খেতে পারতো। এই নিয়ে আমরা অনেক সময় হাসাহাসি করতাম। ওর মা বলতো, ‘আল্লাহ তাআলা আমার মনারে বাঁচায়া রাখুক।’
কিছুদিন পরেই শুনলাম, রাজিব একটি ভ্যান কিনেছে। আমি ওর ভ্যানে চড়া আরম্ভ করলাম। ভাড়া যা হয়, তার চেয়ে বেশি দেবার চেষ্টা করি। একদিন বললাম, রাজিব ভাড়া কেমন হয়?
না, মামা! আমি ছোট মানুষ বইলা কেউ আমার ভ্যানে চড়বার চায় না। বললো রাজিব।
আরেকদিন জিজ্ঞেস করলাম, মামা! লেখাপড়া কি ছেড়ে দিয়েছো?
না, মামা! সকালে আব্বার সাথে কাম কইরা স্কুলে যাই। বাড়ি আইসা খায়াদায়া ভ্যান নিয়া বাইরায়া পড়ি। এবছর মামা ক্লাস সেভেন শেষ করলাম। দুআ কইরেন, যাতে ধইরা রাখবার পারি।
একদিন রাজিবের ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিলাম। একটু পরেই রাজিব বললোÑ
মামা! শইলডা খারাপ আর পারতেছি না।
সাথে আমার বাড়িওয়ালী ছিলেন, তাকে বললাম আমরা একটু কষ্ট করে হেঁটে যাই। ও আমাদের ব্যাগটা নিয়ে যাক। ওর কষ্ট হচ্ছে। কথা বাড়ালো না। আমরা দুজন হাঁটা শুরু করলাম। রাজিব আমাদের ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো।
কিছুক্ষণ পরে বললাম, রাজিব তোর কী হয়েছে রে?
মামা! আমার কিচ্ছু হয় নাই। মার অসুখ। রানবার পারে নাই। তাই খাবার পারি নাই। খিদায় পেট জ¦লতাছে। আমি যা পাই, তাই দিয়ে মার ওষুধ কিনে নিয়ে যাবো।
ভাড়া ছিলো দশ দশ বিশ টাকা। ওর হাতে একশো টাকা ধরিয়ে বললাম, হোটেল থেকে কিছু খেয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি যা।
আসলেই মামা! আজকে ভ্যান চালাবো না। রাজিব চলে গেল।
এর বছর খানিক পরের কথা। দেখলাম রাজিব ব্যাগ নিয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে। বললামÑ
কোথায় যাও?
এই তো যাই মামা!
আজকে না তোমার জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল বেরুবে?
হ্যাঁ মামা! দুআ কইরেন।
দুপুরে ওর মাকে আমাদের বাড়িতে দেখে বললাম, আপা! রাজিব কোথায় গেল?
ভাই! ও ভাগায় ধান কাটতে গেছে।
এতোটুকু ছেলেকে যেতে দিতে পারলেন?
মানা করছিলাম ভাই, শোনে নাই। কইলো, ধান কাইটা না আনলে খাবো কী? এহন তো এলাকায় ভ্যান চলে না।  
ও আপা! ওর রেজাল্টের খবর কী?
আল্লাহ তাআলার রহমতে ভালোই পাশ করছে। সাড়ে চার পয়েন্ট নাকি পাইছে।
ধনীর দুলালদের জন্য এটা একটু কম হলেও যে ছেলে রেজাল্টের দিন ধান কাটতে যায়, তার জন্য সাড়ে চার পয়েন্ট কম কথা না।
রাজিবের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। আমি উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করি। ও শুধু বলে মামা দুআ করবেন। আমি যেনো মার মুখে একবার হইলেও হাসি দেখবার পারি।
রাজিবের এসএসসি পরীক্ষার মাত্র চারদিন বাকি। আমি তখর বাড়িতে গেছি। চিন্তা করলাম, ছেলেটার একটু খবর নিয়ে আসি। চলে গেলাম ওদের বাড়িতে। আমাকে ওর মার অস্থির অবস্থা। কী করবে, কী খাওয়াবে ভেবে পাচ্ছে না।
বললাম, আপা! আমি রাজিবের খবর নিতে এসেছি। ও কোথায়?
কামে গেছে।
এখন কাজ করে কেন? কদিন পরেই পরীক্ষা!
না, এইখান থেইকা থানায় গিয়া পরীক্ষা দিতে হবে। সবাই মিলা মাইক্রো ভাড়া করছে। ওর তো টাকা নাই। তাই কাম কইরা টাকা জমাইতেছে।
কিছু টাকা ওর মার হাতে দিয়ে বললাম, আপা ওকে কাল থেকে কাজ করতে নিষেধ করবেন।
পরীক্ষার আগের দিন আমি বাড়ি থেকে আসবো। রাজিব ভ্যান নিয়ে হাজির। বললাম, মামা! এটা তো হয় না। তোমার কাল পরীক্ষা...!
মাথা নিচু করে বললো, মামা! আপনার দুআ নিবার আইছি।
রাজধানীর ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে ষিক্ষকতা করি। আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তবে তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে পরীক্ষা ওদের নয় ওদের অভিভাবকের। পানির মতো অযথা পয়সা খরচ করে।
আর ওসব ছাত্ররা প্রাইভেটের ওপর এতো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে, রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। নিজে পড়ার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না।
আমার খুব ইচ্ছা ছিলো রাজিবের রেজাল্ট কী হয় দেখবো। কারণ, ও কখনও প্রাইভেট পড়তে পারেনি। তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে একটু আধটু সহযোগিতা পেয়েছে।
ভালো খাবার তো দূরে থাক, প্রয়োজনীয় খাবারটুকুও খেতে পায়নি। অবশ্য পরীক্ষার আগে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা ওর দুধ খাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এছাড়া আর কিচ্ছু নয়।
বিশ্রাম তো পরের কথা, পরীক্ষার আগের দিনও রাজিব ভ্যান চালিয়েছে। শুনেছি। মাঝে একদিন পরীক্ষা না থাকলেও ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছে। কারণ, উপার্জন না করলে পরিবারে খাবার জোটে না।
ছুটি চাইতেই প্রিন্সিপাল সাহেব ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি বাড়ির দিকে ছুটে চললাম। পথে তেমন দেরি হলো না। বাস থেকে নেমেছি। সবসময় রাজিবকে পাই। তবে আজ ওকে আসতে বলিনি। কারণ, আজ ওর রেজাল্ট।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, রাজিব আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। একগাল হেসে বললোÑ
মামা! আসেন। অনেক সময় দাঁড়ায়া আছি। আসবেন, তা আমারে তো কইলেন না।  
মামা! আজ তোমার রেজাল্ট। তাই বলিনি। তবে তুমি জানলে কী করে?
নানার কাছে শুনছি।
কথা না বাড়িয়ে ভ্যানে উঠলাম। প্রতিবেশী মাজেদ কাকাকে পেয়ে তাকেও ওঠালাম। রাজিবকে বললাম, তোমার রেজাল্ট শুনেছো?
না, মামা! এহনও শুনি নাই।
আচ্ছা, রুল নম্বর বলো। আমি ম্যাসেজ দিচ্ছি।
ফিরতি ম্যাসেজে দেখলাম, রাজিব এ প্লাস পেয়েছে। অথচ আমাদের অনেক ধনীর দুলালরাও তা পায়নি।
রেজাল্ট শুনে দেখলাম, রাজিবের হাত কাঁপছে।
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, রাজিবের কাঁপা হাতে একখ- বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ। ও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সফল হাতে।
ধনীর দুলালরা যা পারেনি। রাজিবরা তা করে দেখাচ্ছে। মাজেদ কাকারা এটা বিশ^াস করতে চান না...!

 

ছবি
সেকশনঃ গল্প
লিখেছেনঃ এনামুল করীম ইমাম তারিখঃ 30/10/2019
সর্বমোট 717 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন