ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরে বাংলাদেশে কোনো মুসলমান দেখি নাই। এখন হঠাৎ এতো মুসলমানিত্ব!




















একাত্তরে বাংলাদেশে কোনো মুসলমান দেখি নাই। এখন হঠাৎ এতো মুসলমানিত্ব!

সাইয়িদ রফিকুল হক

 
১৯৭০ সালে, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলো বাঙালিরা। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিকজান্তাদের আইনকানুন ও নিয়মানুযায়ীও পাকিস্তানের (পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিমপাকিস্তানের) শাসনক্ষমতা অর্পিত হবে বিজয়ীজনপ্রতিনিধি হিসাবে বাঙালি-নেতাদের হাতে। সমগ্র বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর কাছে এটাই ছিল প্রত্যাশার বিষয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের সাধারণ নাগরিক তথা মানুষজন তখনও জানতো না যে—পাকিস্তানের মানুষদের মতো এতো ভয়াবহ নৃশংস ও হিংস্র জীব পৃথিবীর আর-কোথাও নাই। বিশেষ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পৃথিবীর সর্বকালের সর্বকুখ্যাত ও নৃশংস জীব ও হায়েনা!
 
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বাঙালিরা পাকিস্তানশাসনের অপেক্ষায় বিভোর ছিল। আর  এমনিভাবে তারা ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাতে ঘুমিয়েছিলো। আর এই ঘুমন্ত মানুষগুলোর উপর মধ্যরাত থেকে আক্রমণ শুরু করলো নির্বাচনে পরাজিত পশ্চিমপাকিস্তানীগোষ্ঠী ও তাদের হায়েনাসদৃশ সেনাবাহিনী। এরা পৃথিবীর সর্বকালের আদিম কামনায় ও পৈশাচিকতায় সম্পূর্ণ উন্মত্ত হয়ে একেবারে অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালি-জাতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় বাঁচার জন্য বাঙালি শুরু করলো প্রতিরোধযুদ্ধ—মুক্তিযুদ্ধ।
 
১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চের কালরাত্রি থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫৬হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডে পাকিস্তানীসামরিকজান্তা নামক জারজগোষ্ঠী ও তাদের জারজসেনাবাহিনী বাঙালি-জাতির উপর স্মরণকালের নারকীয় অত্যাচার-নির্যাতন ও অপকর্ম চালিয়েছিলো। এখানে, তাদের সেই অপরাধসমূহের ক্ষেত্রগুলো থেকে সামান্য কিছু নমুনা তুলে ধরছি:
 
১. নির্বিচারে গণহত্যা;
২. নির্বিচারে হিন্দুহত্যা;
৩. নির্বিচারে নারী ও শিশুহত্যা;
৪. খুন-ধর্ষণ ও গণধর্ষণ;
৫. লুটতরাজ (লুটপাট);
৬. অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি।
 
সেদিন পাকিস্তানীদের সীমাহীন বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা স্বচক্ষে দেখেও আর বাঙালি হয়েও ইসলামের দোহাই দিয়ে বাঙালি-জাতির পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে যারা সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা ও দালালি করেছিলো তারা হলো:
 
১. পাকিস্তানে তথাকথিত ইসলামপ্রতিষ্ঠাকারী ‘মুসলিমলীগ’;
২. ইসলামের ধ্বজাধারী ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান’;
৩. ইসলামের ধ্বজাধারী ‘জামায়াতে ইসলামী পূর্বপাকিস্তান’;
(এদের সহযোগীসংগঠন: শান্তিকমিটি, আল-রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস ইত্যাদি)
৪. ইসলামের পতাকাধারী ‘নেজামে ইসলাম পার্টি’;
৫. ইসলামের সেবক ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ পাকিস্তান;
৬. চট্টগ্রামের ‘দারুল উলুম হাটহাজারীমাদ্রাসা’র ‘মুজাহিদকমিটি’ ওরফে ‘মুজাহিদবাহিনী’ (বর্তমানের শয়তানপুত্র শাহ আহমেদ শফী ও তদীয় ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক ‘হেফাজতে শয়তানে’র জন্ম এখান থেকেই)।
৭. পিরোজপুরের শর্ষিণাছারছীনা আলিয়া মাদ্রাসার মুজাহিদকমিটি;
৮. ঢাকার লালবাগমাদ্রাসার মুজাহিদকমিটি;
৯. কামরাঙ্গীচরমাদ্রাসার মুজাহিদকমিটি;
১০. বরিশালের চরমোনাই ওরফে চোরমোনাইয়ের রাজাকার-পীরগোষ্ঠী এবং তাদের মুজাহিদকমিটি ইত্যাদি।
 
এরা সেদিন দেখেশুনে, জেনেশুনে, বুঝেশুনে ইসলামরক্ষার জন্য পাকিস্তানকে সবরকমের সমর্থন করে বাঙালিনিধনে সর্বপ্রকার শয়তানী, ভণ্ডামি ও বদমাইশী করেছিলো। এদের তখন একবারও ইসলামের কথা মনে হয়নি—মুসলমানের কথা মনে হয়নি। আর মানুষ ও মানবতার কথা মনে হয়নি। আর বাংলাদেশে যে মুসলমান আছে সেকথা তখন এদের কারও মনে হয়নি। তখন বাংলাদেশে মুসলমান ছিল না? পাকিস্তানীহায়েনারা যখন বাঙালি-মুসলমানদের হত্যা করতো তখন এদের মুখে ইসলামের কথা শোভা পেতো! কিন্তু বাঙালি-মুসলমানরক্ষার কোনো কথা ছিল না! এরা মুসলমান বলতে এখনও বোঝে শুধু পাকিস্তান আর পাকিস্তানের জনগণকে। এরা আসলে ইসলামের নামে প্রত্যেকে জঙ্গি আর একেকটা আপাদমস্তকভণ্ড।
 
এই ভণ্ডশয়তানের দল এখন ইসলামের কথা বলে, মুসলমানের পরিচয়ে এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গামুসলমানদের রক্ষার নামে নানাপ্রকার নাটক করছে! আর এদের মায়াকান্নায় দেশ ভেসে যাচ্ছে। কেন ১৯৭১ সালে, অধিকাংশ বাঙালিই তো মুসলমান ছিল। তখন তো এদের কারও মুখে কোনো কথা শুনিনি! যখন ১৯৭১ সালে পাকআর্মিরা নির্বিচারে হিন্দুনিধন করতো তখন এরা উল্লাসপ্রকাশ করতো। আর যখন পাকআর্মিরা বাঙালি-মুসলমানকে হত্যা করতো তখনও এইসব জানোয়ার ইসলামের নামে পাকআর্মিদের মুত খেতো আর তাদের জুতা টানতো!
১৯৭১ সালে, পাকিস্তানীহানাদারবাহিনী জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে মানুষহত্যা করেছিলো। পাকিস্তান ওদের বাপ হয়। ওরা ওদের বাপের পক্ষে ছিল। আর তা এখনও-তখনও। তাই, ইসলামের ধ্বজাধারীদালালগুলো সেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো কথা তো বলেইনি বরং পাকিস্তানের পক্ষে এরা লড়াই করেছিলো। আজ মিয়ানমারে ‘বার্মিজ-আর্মি’ কর্তৃক রোহিঙ্গামুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে এদের বুকটা একেবারে ফেটে যাচ্ছে। পারলে এরা এখনই একদৌড়ে সীমান্ত পার হয়ে আরাকান-রাখাইন-রাজ্যে ছুটে যায় জিহাদ করতে! এমনই অবস্থা এদের।
 
পাকআর্মিদের দালালগুলো এখন ইসলামের স্বেচ্ছাসেবক সেজেছে। এরা নিজেদের এখন এই দেশে ইসলামের মা-বাপ মনে করে। ইসলামদরদী হয়ে এরা এখন বাংলাদেশস্থ মিয়ানমারের দূতাবাস ঘেরাও করতে যায়! এদের কত মুসলমানপ্রীতি! চোরমোনাইয়ের পীর ও তাদের বংশধর ১৯৭১ সালে আজান দিয়ে ‘বাঙালি-মুসলমান’ থেকে শুরু করে নিরীহ হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা করতো, আর পাকআর্মিদের সঙ্গী হয়ে বাঙালিহত্যা করতো। আর সর্বপ্রকার হত্যাযজ্ঞে সবরকমের সহায়তা করতো। আর এরাই এখন রোহিঙ্গামুসলমানরক্ষার জন্য মিয়ানমারের দূতাবাস ঘেরাও করতে যায়! শয়তান আর কাকে বলে! রে ভণ্ডের দল, কে তোদের আপন বেশি? মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাকি স্বদেশীয় বাঙালি? আর তোরা নিজে কি মুসলমান? কক্ষনো না।
 
‘হেফাজতে শয়তানে’র আমির শয়তানপুত্র শাহ আহমেদ শফী ১৯৭১ সালে পাকআর্মিদের জুতা টানতে-টানতে একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো। এখন সেই ভণ্ডশয়তান শফী ইসলামের নামে অপরাজনীতি করছে। আর সেও আজ বলছে: রোহিঙ্গামুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানীদায়িত্ব! কেন রে ভণ্ডশয়তান, ১৯৭১ সালে তোর ঈমান কোথায় ছিল? তখন পাকিস্তানীজানোয়ারদের হাতে অত্যন্ত ভয়াবহভাবে নির্যাতিত বাঙালি-মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো কি তোর ঈমানীদায়িত্ব ছিল না? তখন তোর ঈমান কোথায় ছিল রে? তুই হারামজাদা তখন কোথায় ছিলি? আজ তোর ঈমান এতো বেড়ে গেছে! এখন তুই ঈমানদারি দেখাচ্ছিস!
এখন এরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নামকাওয়াস্তে রোহিঙ্গামুসলমানদের রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে! আসলে, এর পিছনে এদের গভীর ষড়যন্ত্র আছে। অন্য কোনো কু-মতলব আছে। এরা আজ ইসলামের নামে রোহিঙ্গামুসলমানদের জন্য কোনো মানবতা দেখাচ্ছে না। এরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরাসরি এদের স্বার্থের অপরাজনীতি করছে।
 
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের কওমী, আলিয়া ও খারিজী নামক কোনোপ্রকারের একটি মাদ্রাসা কিংবা কোনো মাদ্রাসার কোনো হুজুর কিংবা পাতিহুজুরকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে দেখি নাই। এইসময় দেশের অধিকাংশ মাদ্রাসাই ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প। আর এইসব মাদ্রাসার হুজুর-পাতিহুজুর আজান দিয়ে পাকিস্তানীহানাদারবাহিনীকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলো। এইসব মাদ্রাসাপাস একশ্রেণীর কাটমোল্লা ও মসজিদের ইমাম ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানীআর্মি কর্তৃক বাংলাদেশের নিরীহ জনগণকে হত্যা করাসহ মা-বোনদের ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি পাপকে সম্পূর্ণ জায়েজ বলে ঘোষণা করেছিলো। এরা সরাসরি পাকআর্মিদের সাহায্য করতো। আর দেশরক্ষার মহান কাজে নিয়োজিত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এরাই রাজাকারদের হাতে কিংবা পাকবাহিনীর হাতে সরাসরি ধরিয়ে দিতো। আর এদের অধিকাংশই ছিল আল-রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস। এরা সেদিন ইসলামের দোহাই দিয়ে বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমানদের হত্যা করেছিলো। আর এই ভণ্ডশয়তানরা এখন ইসলামের কথা বলে! এই নরপশুগোষ্ঠীটি এখন ইসলামের ও মুসলমানের দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গামুসলমানদের জন্য মায়াকান্না শুরু করেছে। ধিক্ এই নরপশুদের ধিক্।
 
একাত্তর-সালে পাকআর্মিদের এতো-এতো হত্যাযজ্ঞ! তখন এই মুসলমান কোথায় ছিল? একাত্তরে এইসব মুসলমান দেখি নাই। আর কোথায় ছিল তখন এদের মুসলমানিত্ব?
 
১৯৭১ সালে, এই ধর্মব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের মানুষ ও মুসলমানদের জন্য কোনো দরদ দেখি নাই। এখন এদের রোহিঙ্গামুসলমানদের জন্য দরদ একেবারে উথলিয়ে উঠেছে! হঠাৎ এই দেশে এখন এদের এতো মুসলমানিত্ব কেন?
 
 
 
 

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
১৪/০৯/২০১৭

ছবি
সেকশনঃ ইতিহাস
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 23/09/2017
সর্বমোট 2646 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন