ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ছোটগল্প: আজিজসাহেব ফাঁসির পরোয়ানা হাতে পেয়েছেন




















ছোটগল্প: আজিজসাহেব ফাঁসির পরোয়ানা হাতে পেয়েছেন
সাইয়িদ রফিকুল হক
 

আব্দুল আজিজসাহেব আজ ক্লান্তদেহে বাসায় ফিরলেন। তার মনটিও ভালো নাই। সেখানে নানারকম হতাশা আর দুশ্চিন্তা বাসা বেঁধেছে। এগুলো তাড়াবার মতো মনোবল তিনি যেন খুঁজে পাচ্ছেন না।
 
তিনি বেসরকারি চাকরি করেন। তার চাকরি এখনও আট-বছর আছে। তবুও তার মনে বিরাট দুর্ভাবনা আর বিশাল হতাশা। তার হতাশার কারণ নতুনকিছু নয়—প্রতিবছরের হতাশা পুনর্বৃদ্ধি মাত্র। আর এটির একমাত্র কারণ হলো: হঠাৎ-হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত বাসাভাড়াবৃদ্ধি। কিন্তু প্রতিবছর তার বেতন সে তুলনায় তেমন একটা বৃদ্ধি পায় না। তার দুশ্চিন্তাটা সেখানেই।
 
আজ কদিন যাবৎ তার কেবলই মনে হচ্ছে: তিনি যেন এই শহরে আর বসবাস করতে পারবেন না। জুয়ার আসরের মাতাল-জুয়াড়ীদের মতো ঢাকা-শহরের বাড়িওয়ালারা নিয়মিত বাসাভাড়াবৃদ্ধি করেই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার বাড়িভাড়ার পরিমাণ একদিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর তার সামর্থ্যের বাইরে তা চলে যাবে নাতো? এমন কতকগুলো ভাবনা আজকাল তাকে ভীষণভাবে তাড়া করছে। তাই, তিনি আজও অফিসশেষে বাসায় ‍ফিরে মনমরা হয়ে বসে রইলেন। আজিজসাহেব এই বাড়িটাতে ভাড়াটিয়া হিসাবে আশ্রয় নিয়েছেন তিন-বছর হলো। প্রথমে তিনি বাসাভাড়া দিতেন তেরো-হাজার টাকা। আর এরই সঙ্গে সংযুক্ত থাকতো গ্যাস-বিদ্যু-পানি ইত্যাদি বিল। আরও আছে সার্ভিস-চার্জ। এরপর দুই-বছরে বাড়িভাড়াবৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে সতেরো হাজার টাকা। এ যেন মগের মুল্লুক! আর সবখানে যেন জীবন্তশয়তানের রাজত্ব! আর তাই, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেইসব আফগানি-কাবুলি সুদখোরদের মতো বাড়িওয়ালা নামক নতুনজাতের ভয়ানক সুদখোরগং বাসাভাড়াবৃদ্ধির জন্য প্রতিটি ভাড়াটিয়ার দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। এমনতর কষ্টে এই ঢাকা-শহরে আজিজসাহেবের মতো অনেকেই আজ দিশেহারা। তাদের মুখের সহজ-সরল সেই হাসি আজ হারিয়ে গেছে। আর সেখানে আজ ভর করেছে কৃত্রিম হাসি। সমাজে চলতে গেলে এখন দায়ঠেকে একটুআধটু হাসতে হয় আরকি!
 
আজিজসাহেব আজ ভগ্নমনে বাসায় ফিরে ভাবতে লাগলেন: তার বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে। আর বাকী টাকা দিয়ে তার পুরা-মাসের বাজারসদাই থেকে শুরু করে দুটি মেয়ের স্কুল-কলেজের খরচ চালাতে হয়। এই যখন অবস্থা, তখন নভেম্বর মাসের শেষদিকে বাড়িওয়ালার হুকুমনামা পেয়েছেন। বাড়িওয়ালা আগামীবছর বাড়িভাড়া আরও বৃদ্ধি করতে চায়। এমন একটা পরোয়ানা পেয়ে আজিজসাহেব সত্যি বড় বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এ যেন তার কাছে ফাঁসির হুকুমনামা!
 
আজিজসাহেব ক’দিন পরে ভাবলেন: একবার বাড়িওয়ালার কাছে গেলে কেমন হয়! এরকম একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তবে এতে তিনি ভরসা পান না। কারণ, গতবছর তার স্ত্রী বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছে অনেক অনুনয়বিননয় করেছিলেন বাসাভাড়াবৃদ্ধি না করার জন্য। কিন্তু বাড়িওয়ালা এতে কোনো কর্ণপাত করেনি। তিনি ভাবছেন: এবার হয়তো বললে কাজ হতেও পারে। তাই, তিনি নিজেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতে লাগলেন। তার মনটা কিছুদিন হলো বিষিয়ে আছে। এই সমাজের নগ্নচেহারা দেখে তিনি ভীষণভাবে বিচলিত। আর রাষ্ট্রের নির্লিপ্তভাব দেখে তিনি ভয়ানকভাবে হতাশ। আর রাষ্ট্র যেন এইসব বাড়িওয়ালা-দস্যুর পৃষ্ঠপোষক! তাই, এদের বাড়াবাড়িটা সাধারণ জনগণের সহ্যের বাইরে চলে গেছে। মানুষ কত সহ্য করবে? মানুষ আর কত এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে? আর এই রাষ্ট্র অসহায় মানুষের এই দুর্দশাকবলিত চেহারা ও অবস্থা দেখেও আর কত নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবে? তবে কি রাষ্ট্র আজ শয়তানের পক্ষে?
 
বাসার একচিলতে বারান্দায় বসে সন্ধ্যার পরে আজিজসাহেব এসবই ভাবছিলেন। তিনি কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। দেশের সবখানে আজ ভীষণ গরমিল। আর সবখানে চিরচেনা সেইসব অর্থলোভীউলঙ্গশয়তানদের নগ্নদাপট! আর সবখানে যেন তাদেরই একচ্ছত্র-রাজত্ব। এখানে, আজ বিচার চেয়েও কোনো লাভ নাই। কে করবে বিচার? সর্ষের ভিতরেই যে ভূত!
 
সন্ধ্যার পরে আজিজসাহেব খুব মনমরা হয়ে বাসার একচিলতে বারান্দাটায় বসে ছিলেন। অন্ধকারের মুখোমুখি বসে তিনি জীবনের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত ছিলেন। আর ভাবছিলেন: কেন যে ঝোঁকের বশে সেই গ্রাম ছেড়ে এই শহরে চলে এসেছিলেন! এই শহর তো তার নয়। আর তার মতো সাধারণ মানুষের জন্য এই শহর তৈরি করাও হয়নি। এখানে থাকবে বড়-বড় চোর-টাউট-বাটপাড় আর নষ্ট-রাজনীতির ভণ্ডগুলো। আর এখানে যদি ভালোমানুষগুলো থাকতে চায়—তবে তাদের মুখবুজে সবকিছু সহ্য করে একেবারে জড়পদার্থ হয়ে থাকতে হবে।
 
আজিজসাহেব ভাবতে-ভাবতে একেবারে তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় তার স্ত্রী রোখসানা তার ধ্যানভঙ্গ করে বললেন, “তোমার চা নাও।” কথাটা বলে তিনি ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। আবার কী মনে করে একটু থেমে বললেন, “চা-টা শেষ করে তুমি আজ বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা কর। আর বাড়িভাড়ার বিষয়টা এখনই ফয়সালা করে ফেলা দরকার। আর ক’দিন পরেই তো তোমার ছোট মেয়েটির বার্ষিক পরীক্ষা। এইসময় বাসা নিয়ে সমস্যা হলে মেয়েদের পড়ালেখায় ক্ষতি হবে। তারচে তুমি একবার বাড়িওয়ালা অ্যাডভোকেট-সাহেবের কাছে যাও। তিনি এবার হয়তো একটু নরম হতেও পারেন।”
স্ত্রীর কথা শুনে আজিজসাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। আর দেখলেন: তার স্ত্রী এর একটা জবাব না-শুনে যাবে না। তাই, তিনি সবদিক ভেবেচিন্তে শুধু বললেন, “আচ্ছা। একটু পরেই আমি যাচ্ছি।”
 
আজিজসাহেব আবার ভাবতে লাগলেন: এই দেশের মানুষগুলো এতোটা বেপরোয়া আর জালিম হয়ে উঠছে কেন? আর তাদের অর্থমোহ একেবারে পাগল করে তুলছে! অথচ, কত আশা নিয়ে এই দেশের ত্রিশলক্ষ মানুষ অকাতরে জীবন দিয়ে দেশস্বাধীন করেছিলো। আর সেই দেশের একজন বাড়িওয়ালা অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ আজ ডাকাতের মতো সাধারণ ভাড়াটিয়াদের উপর চড়াও হচ্ছে। আর তাদের দাবি মতো প্রতিবছর বাসাভাড়াবৃদ্ধি করতে না পারলে ভাড়াটিয়াদের বাসাছাড়ার নোটিশ হাতে নিয়ে চুপ হয়ে যেতে হয়! এই দেশে আজ এসব দেখার কেউ নাই। কী আজব দেশ এটা। এখানে, মানুষের আজ কোনো মূল্য নাই। সবকিছু আজ অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা হচ্ছে। আর এখানে, আসলে মানুষের কোনো ধর্ম নাই। সব ভণ্ড আর জোচ্চোর। যৌবনকালে দুনিয়ার সমস্ত অকাম-কুকাম করে বৃদ্ধবয়সে মুখে চার-আঙ্গুল-পরিমাণ দাড়ি রেখে কিংবা এই দাড়িসমেত একবার হজ্জ করতে পারলে তারচেয়ে বড় ধার্মিক আর কেউ হবে না। এখানকার মানুষগুলো আজ ভয়ানক ব্যাধিগ্রস্ত। এদের কোনো মানবতা নাই। এদের কোনো মনুষ্যত্ব নাই। এদের জীবনে শুধু অধর্ম। কিন্তু এদেরই মুখে-মুখে আছে লোকদেখানো যত ধর্মের বুলি। এই দেশের মতো ভণ্ড আর কোন দেশে আছে? আর কোন দেশে আছে ধর্মের ভেকধারী এমন অধার্মিক?
 
বুকের ভিতরে একসাগর দুঃখ নিয়ে আজিজসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। তার স্ত্রী রোখসানা দরজা আটকিয়ে মনে-মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন: এবার যেন বাড়িওয়ালা তাদের কথাটা শোনে!
 
চারতলা থেকে দোতলায় নামতে আজিজসাহেবের বেশি সময় লাগলো না। মনে ইতস্ততঃভাব থাকা সত্ত্বেও আজিজসাহেব বাড়িওয়ালার বাসার কলিংবেল চাপলেন।
দরজা খুলে দিলো বাসার কাজের মেয়েটি। আজিজসাহেব বাড়িওয়ালার নাম করতেই মেয়েটি তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে আজিজসাহেব দেখলেন, বাড়িওয়ালাসাহেব আসছেন। তাকে দেখে আজিজসাহেব মনভরে সালাম দিলেন।
বাড়িওয়ালা রশিদসাহেব কয়েকগাল হেসে আজিজসাহেবকে ভিতরে বসতে বললেন।
বসার পরপরই রশিদসাহেব বেশ ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো, “যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন আজিজসাহেব। একটু পরেই আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবো। আমি আবার জামাতে নামাজ আদায় না করে থাকতে পারি না।”
এতে আজিজসাহেব ভিতরে-ভিতরে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন। তবুও তার স্ত্রীর করুণ মুখের কথা মনে হতেই তিনি বলে ফেললেন, “বলছিলাম কি ভাইসাহেব, এবছর বাড়িভাড়াটা না বাড়ালে আমার বড় উপকার হয়। আপনি যদি একটু মেহেরবানী করে আগের ভাড়াটা বহাল রাখেন তাহলে আমার বড় উপকার হবে।”
এতে রশিদসাহেব বললো, “দেখেন, এখন নামাজের সময় হয়ে আসছে। অন্য সময় হলে আমি আপনার কথার ব্যাখ্যা দিতে পারতাম। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে: নতুন-বছরে আপনাকে দুই-হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে। কথাটা শেষ করে রশিদসাহেব উঠে দাঁড়ালো আর বললো: আমার মসজিদে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। অন্য একদিন আসবেন, আপনাকে সিলেটের তাজা-চা খাওয়াবো। আজ আর আপনাকে সময় দিতে পারছি না।” এরপর লোকটি মাথার টুপি ঠিকঠাক করতে লাগলো।
 
বাড়িওয়ালার কথা শুনে আজিজসাহেব বিমর্ষচিত্তে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে যেন কোনো ভাষা নাই। তিনি যেন এইমাত্র বোবা হয়ে গেলেন। তবুও তিনি শক্তিসঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ালেন। আর ভাবলেন: তিনি এতোক্ষণ একটা শূয়রের বাচ্চার সঙ্গে কথা বলেছেন।
 
আজিজসাহেব আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার মনে হলো: তিনি যেন বড় ধরনের অপরাধী। আর এই মাত্র তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে।
আজিজসাহেব খুব ধীরপদে সিঁড়ি-ভেঙে উপরে উঠতে লাগলেন। এইসময় দুঃখভারাক্রান্ত আজিজসাহেবকে দেখে মনে হলো: সত্যি-সত্যি তিনি যেন এই মাত্র তার ফাঁসির পরোয়ানা হাতে পেয়েছেন।
 
 



 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/১১/২০১৬
 
 

ছবি
সেকশনঃ গল্প
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 25/04/2017
সর্বমোট 3065 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন