ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

হেডমাস্টার ও আমার কিছু স্মৃতি

(১) সময়টা ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। বিদ্যালয় পাঙ্গন ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় পরিপূর্ণ। ক্লাসের ঝামেলা নেই।তাই ছাত্ররা কয়েকটা দল বেধে আড্ডা দিচ্ছে।আর ছাত্রীরা কমন রুমের করিডোরে কাছাকাছিতে সবাই খোশ গল্প জমিয়ে নিয়েছে।সেদিন স্কুলে একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।তাই স্কুলের ছাত্রদের ক্লাসের কোন চিন্তা মাথায় নেই। তবে অনুষ্ঠানের শুরু হবে ১১টায়।তাই সে সময় আসার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সে আড্ডা, খোশ গল্পের ব্যাঘাত ঘটাবে না। সবাই যেন প্রফুল্লিত হয়ে নেচে গেয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। এর মাঝে কতিপয় ছেলে-মেয়ের চোখের মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে।আমিও সে কতপয় ছেলে-মেয়ের দলের একজন। কাঁলো মেঘ,ঘন কুয়াশা, অরিন্দম বাতাস সব আমাদের ভর করেছে। আচমকা আমার চক্ষু শ্যাম স্যারের দিকে দর্শন করতে থাকে। আমার চক্ষু জুগল যা দেখলো আর আমি যা বুঝতে পারলাম। কাঁলো মেঘ,ঘন কুয়াশা,অরিন্দম বাতাস শুধু আমাদের উপর আবিষ্ট হয়নি।সম্মানিত প্রধান শিক্ষকের উপরেও আবিষ্ট হয়েছে। পরক্ষনেই আমার এ চক্ষু একই রকম কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করলো। যা প্রত্যক্ষ করলো, প্রত্যেকটা স্যারের মুখে বিষন্নতার ছাপ।আর আমার সহপাঠিরা ভোরা কান্ত হৃদয় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পূর্ণ করতে যে নিয়ামক বা উপাদানগুলো প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করছে। বিরাট একখানা ব্যানার তৈরী করা হয়েছে।যেখানে আমার সহপাঠীর প্রত্যেকজনের ছবি রয়েছে।ছবিতে প্রত্যেকে অনেক হাসি খুশি দেখা যাচ্ছে।কিন্তু রক্তমাংসের দেহে স্পষ্ট মলিনতার ছাপ।। (২) একটা লোক প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো।দেখতে বেশ সুন্দর।তার ঠোঁটের গোড়ে যেন একপশলা মিষ্টি হাসি এসেই থাকতো।বাবার সাথে প্রয়োজনীয় কি সব কথা শেষ হলে আবার চলে যেত।আমার বয়স তখন কতই আর হবে? আপনার ঐ ৮/৯ এর কাছাকাছি হবে তো। তখন খুব সম্ভবত চতুর্থ শ্রেনীতে আমি অধ্যয়ন করতাম।আমাকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতো,"কেমন আছ বাবু!! আমি কিছুই বলতাম না।শুধু তাকিয়ে মাথাটা নাড়িয়ে দিতাম।তার চলাফেরাতে মনে হত। তিনি খুব ব্যস্থ মানুষ। তাই খুব তাড়াহুড়ো করে বাবার কাছে যেত। আমি বাবাকে জিঙ্গেস করতাম,আব্বা ঔ লোকটা কে? বাবা উত্তর দিতো,স্কুলের হেডমাস্টার বাবা। আমি সে কথা শুনিয়া। নিজে নিজেই ভাবতে থাকতাম।স্কুলের হেডমাস্টার তো কাশেম নানা।তাহলে এনি কিভাবে হেড মাস্টার হন।বাবা খুব রাগি গোছের মানুষ ছিলেন।তাই তাকে পুনরায় কোন প্রশ্ন করতাম না।খুব ভয় পেতাম।আসলে তখন বুঝতাম স্কুলের হেডমাস্টার একজন হয়।দুজন হবে কিভাবে? আমার মাথায় ঢুকতো না যে, একেকটা স্কুলে একেকজন হেডমাস্টার থাকে।প্রাইমারীর স্কুলের আর হাই স্কুলের বড় স্যারকে হেডমাস্টার বলা হয়।এসব আমার মাথার মধ্যে ছিলও না।আর এত গভীর ভাবে কখন চিন্তা করেও দেখিনি।হ্যাঁ।গভীর ঐ তো।একটা ৯বছরের বাচ্চার কাছে এটা একটা গভীর বিষয়ই বটে। দেখতে দেখতে আমি পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র হয়ে যাই।একটা বছর আমার খেলাধুলার মাঝেই কেটে গেছে।তাই টের পাইনি।আমি খুব ভালো পড়তে পারতাম না।তাই প্রায় প্রত্যেকদিন শ্রদ্ধেহ শামসুল রহমান স্যারের ঝারি শুনতাম, অংক না পারলে,পাছায় বেতের বারি খেতাম। তিনি রেগে গিয়ে প্রায়ই বলতেন, এই আলতাবের ছেলেটা কিছুই পারে না।আমি কিছুই বলতাম না।কারন আমি সত্যিই তো পারি না।সামনে চলে আসলো সমাপনী পরিক্ষা।আমাকে সমাপনী উচ্চারণ করিতে দিলেই আমি পারতাম না।এমন গোছের একটা ছাত্র।সেই সমাপনী পরিক্ষা দিয়ে টেনে হেছড়ে পাশ করলাম। স্কুল থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে সবাই মিলে সামনে হাঁঠছি।এমন সময় সেই মিষ্টি হাসি দেয়া লোক সামনে এসে দাড়ায়। ততোদিনে তাকে চেনা হয়েছে। ভালো করেই চেনা হয়েছে।আর কেন বাবার কাছে প্রায়ই ছুটে যেত তাও জানতে পেরেছি ততোদিনে। আমার বাবা ছিলেন, পৌষার আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। ((বর্তমানে তা পরিবর্তন করে সম্মানিত দাদা সাধন কর কে প্রতিষ্ঠাতা করা হয়েছে)) আর সেই লোকটা সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।তাই বাবার দরকার প্রায়ই হত। প্রধান শিক্ষক মিষ্টি হাসি ঠোঁটের কণায় এনে বললো, দেখি বাবু তোমার সার্টিফিকেট টা। আমি দিয়ে দিলাম।কারন তার ঐ মিষ্টি হাসির জন্যে আমি তার প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখান করতে পারিনি।আমার সাথে থাকা সহপাঠিদেরকে বললো, আর তোমরাও আমার সাথে এসো। তারপর আমরা স্যারের পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম।এই দৃশ্যকে তুলনা করলে হ্যামিলিয়নের বাশিওলার গল্পের দৃশ্যের সাথে তুলনা করা যায়।স্যার সামনে চলছে আর আমরা পিছু পিছু চলছি সব পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান। অবশেষে আমরা বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়লাম।তিনি নিয়ে গিয়ে সবাইকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে নিলেন।অনেকে হয়তো অন্যত্র ভর্তি হওয়ার মত হতে চেয়েছিল।কেও বা পড়াশোনা বাদ দিতে চেয়েছিল।কিন্তু স্যার সবার সার্টিফিকেট নিয়ে সবাইকে ভর্তি করে নিলেন।উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারটা একদম অন্যরকম।তারপর আমার উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়াশোনার পর্ব শুরু হলো। তারপর থেকে সে লোকটার সাথে দেখা সাক্ষাত বেশি হতে লাগলো।তার সম্পর্কে আরো জানতে পারলাম। সত্যেকটা ছাত্রের ভীষন পছন্দের টিচার তিনি।তিনি মিষ্টি কথা বলে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করতে সক্ষমতা রাখে। সত্যি বলতে তার হাসিটাকে ভীষন ভালো লাগতো।খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতো।মানুষের মন আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায় এ মানুষটার সাথে কথা বললে। তিনি খুব আদর্শ প্রধান শিক্ষক।তিনি বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য সেই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমার দেখা তিনি একজন আদর্শ নীতিবান সৎ মানুষ ও বটে। তিনি যতটা দিয়েছেন বিদ্যালয়ের জন্য এমন ভাবে পরিশ্রম করে কিনা এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অঙ্গাত। বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ।তারাও হেডমাস্টারকে সহযোগিতা করেন।তাদের পরিশ্রমে বিদ্যালয় এখন অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানে রুপ নিয়েছে। আমি দেখেছি, পুরো পাঁচটা বছর ধরে দেখেছি।তার মত মহান স্যারকে দেখেছি।তার মত একজন আদর্শ হেডমাস্টারকে দেখেছি। তিনি ছাত্রদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে।সুন্দর সুন্দর কথা বলে বুঝাতেন।মিষ্টি হাসি দিয়ে কথা বলতো ঠিকি।তবে হাসির মাধ্যের দোষটাও আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিতো।যা প্রত্যেকট ছাত্রের জন্য দরকার।আমাদের সে এলাকায় শিক্ষার হার খুব ছিল।প্রত্যেকটা গ্রামে তাকে যেতে দেখেছি।গ্রামের মানুষদের বুঝাতে দেখেছি।এত এত কিছু করে সে আমাদের অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন।তিনি মহান।তার কর্মও মহান। প্রত্যেকটা ছাত্রকে অকৃত্রিমভাবে ভালবাসতেন। নিজের সন্তানকে একজন মানুষ যেমন ভালোবাসে ঠিক তেমনি।। (৩) ঘড়ির কাটায় ঠিক এগারো বেঁজে গেছে।প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি সবাই মঞ্চের উপরে অবস্থান করছে।মঞ্চের সামনে সকল শিক্ষার্থী পিনপতন নীরবতা পালন করছে।আর আমরা অর্থাৎ বিদায়ী ছাত্ররা মঞ্চের বামপাশে বিষন্ন মনে বসে আছি। অনুষ্ঠান শুরু করতে প্রধান শিক্ষক মাউথ স্পিসের সামনে আসলেন।এসেই তিনি একটা মিষ্টি হাসি দিলেন।নীরব শিক্ষার্থী ও আমরাও তার হাসিতে প্রফুল্ল হয়ে গেলাম। আগেই বলেছি।তার ঠোটের কণার এক পশলা হাসি।অনেক মারাত্মক। যে হাসিতে যে কেও মমের মত গোলতে বাধ্য।তিনি সুন্দর করে অনুষ্ঠান সূচনা করে।তার আসনে গিয়ে বসলেন। তারপর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। কিছু জ্ঞানগর্ভ আমাদের উদ্দেশ্য কিছু সম্মুখে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন পরিক্ষা বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখলেন।যা আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। আমাদের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মাঝে থেকে কয়েকজনের দিয়ে বক্তব্য রাখা হলোআমি ছিলাম তার মধ্যে একজন। স্কুল থেকে বিদায়ের কথা মনে হতেই বক্তব্যের মাঝে কান্না চলে আসলো।সে বিদায় যদিও ক্ষনস্থায়ী বিদায়।তারপরেও বুকের মাঝে শূন্যতা অনুভব হচ্ছিল।পাঁচটা বছর কাটিয়ে দেয়া পিতা সমতূল্য সব শিক্ষকদের কি করে ভোলা যাবে!! এসব ভাবতে কান্না পাচ্ছিল। এরপর আবার আমাদের সম্মানিত হেডমাস্টার বক্তব্য রাখতে আসলেন। এবার তার মুখে হাসির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না।তাই সামনের সব শিক্ষার্থীর মাঝে পিনপতন নীরবতা দেখা গেল। প্রথমে এসে তিনি সবার মন প্রফুল করেছিলেন। এবার মনে হচ্ছে কাঁদাবে। হুম সত্যি সবাইকে কাঁদিয়ে ছাড়লেন।তার বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের বিদায় দেওয়ার বেদনাকে খুব করে প্রকাশ করলেন। বিদায়ী শিক্ষার্থীরা যেন বেদনার অতল গহর্বে তলিয়ে গেছে।তারা যেন স্যারের সাথে সাথে ফুপিয়ে কান্না করে চলেছে। তিনি হেডমাস্টার,মহান হেডমাস্টার।তিনি শিক্ষার্থীদের ভালবাসতে পারে।শাসন করতে পারে।খুশি রাখতে পারে।কাঁদাতেও পারে। সেই বিশেষ দিনের মুহুর্তগুলো খুব ধীর গতীতে পার হচ্ছিল। অনেক সৃতিবহুল সেদিন।সবগুলো কষ্টের সৃতি। নেরেন দা।(পিয়ন) অনেক ভালো মানুষ।সেও বিদায় দিতে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে কান্না করে দিয়েছিল। সেদিন কষ্টের মাঝেই পার হয়। তারপর সে বিদ্যালয়।সেই সৃতিঘেরা ক্লাসরুম।সেই প্রিয় শিক্ষকগন।সেই প্রিয় নেরেনদা।সবার প্রিয় হেডমাস্টার।সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে সেদিন বিদায় নিতে হয়।।।

ছবি
সেকশনঃ গল্প
লিখেছেনঃ আমিনুল ইসলাম তারিখঃ 27/02/2017
সর্বমোট 5997 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন