ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কাটপিস, জোড়াতালি দেওয়া আর চটি-বইয়ের রাজত্ব



বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কাটপিস, জোড়াতালি দেওয়া আর চটি-বইয়ের রাজত্ব
সাইয়িদ রফিকুল হক
 
বাংলা একাডেমীর বইমেলা শুরু হয়েছিলো সৃজনশীল-পুস্তক-প্রকাশনার জন্য। আর একটা সময় বইমেলায় সৃজনশীল-বই-ই প্রকাশিত হতো। এখন দিনকাল বদলে গেছে। অনেক আগাছা-পরগাছাও এখন লেখক হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে। লেখক হওয়ার প্রচেষ্টা দোষের কিছু নয়। কিন্তু লেখকের থাকতে হবে মৌলিক-প্রতিভা। কিন্তু এরা চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী। চুরিই এদের একমাত্র সম্বল। এরা লেখক হওয়ার যোগ্য নয়। তবুও এরা জোড়াতালি দিয়ে লেখক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। একশ্রেণীর তস্কর এখন লেখক হওয়ার সর্বাত্মক-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদের মদদদাতা হচ্ছে একশ্রেণীর টাকালোভী-প্রকাশক।
প্রতিবছর বাংলা একাডেমীর বইমেলা ঘুরেফিরে দেখা যায়, সেখানে পাঁচ-ছয়শ্রেণীর বইয়ের খুবই আধিক্য। মানে, সর্বত্র এসব বইয়ের ছড়াছড়ি। এগুলোই এখন জাতির কাঁধে চেপে বসেছে।
 
এইসব বই-নামক চটি-বইগুলো হলো:
১. ভূতের বই বা ভূতবিষয়ক গল্পের বই: মেলার সর্বত্র ভূতের বইয়ের ছড়াছড়ি। চিংড়ি-মাছের ভাগার মতো এগুলো চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। আর সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো প্রায় সব প্রকাশকই দুই-চারটি করে ভূতের বই মেলায় রাখে। এতে শিশুদের কাছে টেনে তাদের পকেট কেটে কিছু কাঁচাপয়সা উপার্জন করা আরকি। একসময় ভূতের গল্প লিখতেন আমাদের বাংলাসাহিত্যের প্রথিতযশা-লেখকবৃন্দ। আর এখন ভূতের বই লেখে কিংবা অন্যের লেখা চুরি করে জোড়াতালি দিয়ে কিংবা সরাসরি অন্যের ছাপানো বই থেকে কাটপিস আকারে কেটে তালি দিয়ে ভূতের বই ছেপে বাজারে ছাড়ছে একশ্রেণীর পাগলছাগল। এরা লেখক নয়—এরা সরাসরি সমাজবিরোধী বদমাইশ। আর এইসব কাটপিস বইগুলো যারা ছাপাচ্ছে তারা আরও বড় বদমাইশ। আজকাল অনেক বখাটেই ভূতের বই ছাপাতে উৎসাহী হয়ে উঠছে। এরা সরাসরি অন্যের লেখা চুরি করে ভূতের গল্প সাজাতে বেশ পারদর্শী। কিন্তু এদের কারও ক্ষমতা নাই সত্যিকারের সাহিত্যমণ্ডিত ভূতের গল্প রচনা করার। তবুও বাংলা একাডেমীর বইমেলায় এসব অখাদ্য-কুখাদ্য সমানতালে চলছে।
 
আমাদের দেশের সত্যিকারের লেখকরা অনেক মজার-মজার ভূতের গল্প লিখে গেছেন। এগুলো বাংলাসাহিত্যের অমরসৃষ্টি। এগুলো এখনও হুবহু ছেপে আমাদের দেশের শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। এজন্য কোনো বদমাইশকে এদের লেখা চুরি করে কথিত-শিশুসাহিত্যসৃষ্টি করতে হবে না। এইসব মূর্খের দৌরাত্ম্যে ভূতের গল্পগুলো এখন শ্রীহীন হয়ে তা ভাগাড়ে যেতে বসেছে!
 
২. কথিত-সায়েন্স-ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান: আমাদের দেশে একটা সময় ড. আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন বিজ্ঞানবিষয়ক চমৎকার বই লিখতেন। এগুলো আমাদের আনন্দের খোরাক ছিল। আর এখন বিজ্ঞানবিষয়ক বই নিষিদ্ধ হয়ে বিজ্ঞানের নামে চলছে হুজ্জোতি আর বজ্জাতি। এখন রচিত হচ্ছে সস্তা সায়েন্স-ফিকশন। উন্নতমানের সায়েন্স-ফিকশন রচিত হলে তবুও কোনো কথা থাকতো না। এখন যে-সে সায়েন্স-ফিকশন লিখছে টু-পাইস কামানোর জন্য। আমার জানামতে বাংলাভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট সায়েন্স-ফিকশন লিখে গেছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর অমরসৃষ্টি ‘প্রফেসর শঙ্কু’ এখনও আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। দেশে এখন বিজ্ঞানশিক্ষার চলছে আকাল। আর এই সুযোগে কতিপয় টাউট-বাটপাড় শিশুদের মাথানষ্ট করার জন্য শুরু করেছে আবোলতাবোল, উদ্ভট ও নিম্নমুখী সায়েন্স-ফিকশন। আর এগুলো সাহিত্যের মানদণ্ডে কোনোপ্রকার গ্রন্থ বলেই বিবেচিত হয় না। তবুও বইমেলায় এগুলোরই প্রচার ও প্রসার বেশি।
৩. মুক্তিযুদ্ধের বই বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই: মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চিরগৌরবের বিষয়। এখন কারও-কারও কাছে এই মহান মুক্তিযুদ্ধ টাকা-পয়সা কামানোর অবলম্বন। একশ্রেণীর অকাট-মূর্খ এখন নাম-কামানোর ও টাকা-রোজগারের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অতিসস্তা বই লিখছে। এসব বইয়ের তত্ত্ব ও তথ্যের কোনো ঠিক নাই কিংবা এগুলো বিকৃত। তবুও এসব বই ছাপা হচ্ছে দেদারসে। আর এর মদদদাতা ঐতিহাসিক বাংলা একাডেমী। দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট এখনও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এতদ্বিষয়ক বই ছাপিয়ে টাকা-পয়সা কামানোর ধান্দা করছে একটি ধান্দাবাজশ্রেণী। এদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা নাই, এই বিষয়ে অধ্যয়ন নাই, তবুও ওরা এই বিষয়ে ভুলেভরা বই লিখছে। আর এগুলো বাংলা একাডেমীর মেলায় চলছে।
 
৪. অপাঠ্য ও অরুচিকর কবিতার বই: আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রকাশকই এখন বেশ্যার মতো। এরা টাকা পেলে যারতার বই ছাপে। কিন্তু নিজের থেকে ভালো লেখক কিংবা নবীন-লেখকদের ভালোমানের বই ছাপে না। এদের যে-কেউ টাকা দিলে এরা তার বই ছেপে প্রতিবছর মেলায় ছেড়ে দেয়। আর মেলাশেষে বইগুলো নীলক্ষেতের ফুটপাতে ২০ টাকা, ২০ টাকার কারবারে চলে যায়।
সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম, প্রধানতম ও শক্তিশালী শাখা হচ্ছে কবিতা। আর এখন সেই কবিতা পারলে প্রায় সবাই লেখে! একশ্রেণীর পাগলছাগল কবি হওয়ার জন্য এখন আদাজল খেয়ে লেগেছে। আর এদের উৎসাহ দিচ্ছে এইসব পতিতাশ্রেণীর প্রকাশক। কবিতার নামে এখন চলছে ভণ্ডামি। বানান জানা নাই, শব্দজ্ঞান নাই, ছন্দ জানে না, ছন্দ বোঝে না—এখন এরাও কবিতার বই ছাপাচ্ছে! আর তা প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলা একাডেমীর মেলায়।
 
৫. নামসর্বস্ব ও প্রচারমুখী কিছুসংখ্যক লেখকের বই: এদেশের কিছুসংখ্যক দৈনিক পত্রিকার কল্যাণে কিছু ব্যক্তিবর্গ হঠাৎ করে কবি-লেখক হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমীর বইমেলায় তাদের বইয়ের লাফালাফি চোখের পড়ার মতো। এসব বইয়ের না আছে কোনো সাহিত্যমূল্য আর না আছে বাস্তবতার ছোঁয়া। তবুও এগুলো বইমেলায় শোভা পাচ্ছে। আর বাংলা একাডেমীর কর্তাব্যক্তিরা এসব বইয়ের প্রচারে ও প্রসারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।
৬. বিদেশী কাহিনীনির্ভর হ্যারি পটার ও ডরেমন জাতীয় বই: মহান ভাষাআন্দোলনের মাসে বিশেষ গৌরবের সঙ্গে এসব বই বিক্রি হচ্ছে।
 
ভাষার মাসে ভাষাপ্রেমের কোনো বই খুঁজে পাইনি এবারের বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। কেউ এর সন্ধান পেলে বা এর নাম জানলে এই খাকসারকে জানাবেন। বইটি কিনে ভালোবেসে পড়বো। আর তার জন্য দোয়া করবো।
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/০২/২০১৭
 
 

ছবি
সেকশনঃ সাম্প্রতিক বিষয়
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 12/02/2017
সর্বমোট 7390 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন