ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

অমলতাস রোড

হলদে ফুলের বাহার ছড়ানো শান্ত-সুন্দর একটি রাস্তা। তার দুপাশ জুড়ে অসংখ্য অমলতাস ফুলের গাছ। বলা হয়, অনেক বছর আগে কোনো এক বৃক্ষপ্রেমিক নিজ উদ্যোগে এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। তাই এই রাস্তাটিকে বলা হয় অমলতাস রোড। কত স্মৃতি জড়ানো এই রাস্তাটি। কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে বসুন্ধরার বুকে শয়ন করছে এই পথ। রোজ সকালে সূর্যকিরণ অমলতাসের ঘন পাতার ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে আলোকিত করে পিচঢালা এই পথটিকে। পাড়ার ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী,বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সকলের পদচারণায় মুখরিত হয় এই পথ। এই পথে সৃষ্টি হয় কতো গল্প। জেগে ওঠে কত প্রাণ। এই পথে এসে কেউ খুঁজে পায় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপ। অমলতাসের পাপড়ি এ পথে ছড়ায় হলুদ রঙের বাহার। পাখীর কলকাকলি ভরিয়ে দেয় মন। এমনই সৌন্দর্য ছড়ায় এই অমলতাস রোড। রাহী এই অমলতাস রোডের নিয়মিত পথিক। রোজ সকালে এই পথ ধরে সে কলেজে যায়। প্রকৃতিপ্রেমিক রাহী এই রাস্তাটি খুব পছন্দ করে। রাস্তার দক্ষিণ পাশে বিশাল আকৃতির একটা অমলতাস গাছ রয়েছে। রাহী খুব পছন্দ করে এই গাছটিকে। অন্যান্য গাছের তুলনায় এই গাছটা খুব প্রশস্ত। রাহী রোজ এই গাচতলায় বসে সময় কাটায়, একাই। একাকীত্ব ওর প্রিয়। আর একাকীত্বকে উপভোগ করবার জন্য এই অমলতাস রোড ওর কাছে সেরা। দুপুরের পর ওর কলেজ ছুটি হয়। এর পরই সে চলে আসে ওর প্রিয় এই অমলতাস রোডে। সারাটা বিকাল সে এখানেই সময় কাটায়। সন্ধ্যা নেমে এলে বাসায় যায়। সেদিনও ঠিক একই নিয়মে সে কলেজ শেষে সাইকেল নিয়ে আসছিলো। অমলতাস রোডের ওপর দিয়ে তার সাইকেলের চাকা দুটো ঘুরছিলো। চাকাদ্বয় থামবে ঠিক বড় অমলতাস গাছটার সামনে, এটাই প্রতিদিনের নিয়ম। কিন্তু সেদিন এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো। সাইকেলের চাকাজোড়া বড় অমলতাস গাছটার কাছে যাবার আগেই সেদিন থেমে গেলো। থেমে গেলো এক অপরিচিতার সামনে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন এই অপরিচিতা রাহীর সাইকেলের সামনে এসে পড়লো। ভাগ্যিস! সময়মত রাহী সাইকেল থামিয়েছিল। নইলে শান্ত-সুন্দর অমলতাস রোডজুড়ে আজ কোনো সূক্ষ্ম আর্তনাদ বয়ে যেতো। অপরিচিতা ভয়ে হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলেছিলো। রাহী তার কাছে গিয়ে অনেকটা শান্তভাবে তাকে আস্বস্ত করলো যে ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক আছে। মেয়েটি স্বাভাবিক হলো। মুখমণ্ডল হতে হাতজোড়া সরিয়ে নিলো। এই হাতজোড়া সরিয়ে নেবার দৃশ্যটি অপূর্ব লেগেছিলো রাহীর কাছে। মেয়েটির পড়নে ছিল একঢালা সাদা রঙের পোশাক। দুই হাত ভরা নীলরঙা চুড়ি। যখন এই অপরিচিতার রূপ পূর্ণতা পেলো রাহীর সামনে, রাহী যেন অদ্ভুত এক মুগ্ধতার মাঝে হারিয়ে গেলো। মেয়েটি হয়তো অপরূপা নয়, তবু তার মাঝে যেন স্বর্গীয় কোনো সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছিলো। অমলতাস রোডের সৌন্দর্য যেন তার এই সৌন্দর্য দেখে হিংসায় জ্বলছে। হলুদের মাঝে যেন নেমে এসেছে কোনো শুভ্র পরী। রাহী কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকলো মেয়েটির দিকে। একমুহূর্তে যখন সে বুঝতে পারলো যে মেয়েটি অস্বস্তি বোধ করছে, তখন রাহী নিজেকে স্বাভাবিক করলো। রাহী তার পরিচয় জানতে চাইলো। মেয়েটির সাথে কথা বলে সে জানতে পারলো যে, মেয়েটি এসেছে শহর থেকে। পাশের এলাকায় থাকছে দু সপ্তাহ হলো। সেখানে মেয়েটির এক আত্মীয়ের বাড়ি। কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। বিকালবেলায় ছোট কাজিনের সাথে হাটতে বের হয়েছিলো। কিন্তু কাজিন তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলে কোথায় যে উধাও হয়েছে তার কোন খবর নেই। নতুন এলাকায় অচেনা রাস্তায় একা মেয়েটি প্রায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটির কথা শুনে রাহী এটুকু বুঝতে পারলো যে সে অত্যন্ত সহজ-সরল। তার সাথে আরো বেশি পরিচিত হতে ইচ্ছা করছিলো রাহীর। সে মেয়েটিকে তার সাথে আলাপ করবার প্রস্তাব জানালো। মেয়েটি সম্মত হয়। রাহী তার সাইকেল ধরে চলছিলো। পাশে হাটছিলো মেয়েটি। তার নাম পৃথ্বী। আলাপ করতে করতে তারা গিয়ে বসলো ওই বড় অমলতাস গাছটার তলে। পৃথ্বী ভীষণ উপভোগ করছিলো পরিবেশটাকে। রাহীর ভালো লাগছিল মেয়েটির মুখে সন্তুষ্টি এবং মুগ্ধবোধ দেখে। পৃথ্বী থাকে ইট-পাথরের শহরে। এমন খোলা আকাশ, শান্ত পরিবেশ, বাতাস এবং পাতার যৌথ সঙ্গীত পৃথ্বী হয়ত আগে কখনোই উপভোগ করবার সুযোগ পায়নি। প্রকৃতির মাঝে এসে তাই আজ মেয়েটি যেন প্রকৃতির মাঝেই হারিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ নীরবে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করবার পর রাহী প্রশ্ন করলো, "আছেন? নাকি হারিয়ে গেছেন?" রাহীর কথা শুনে পৃথ্বী ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো, "হারিয়েই গেছি।" বলেই পৃথ্বী আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। রাহীও পৃথ্বীর সাথে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। বিকেল গড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিম আকাশে ডুব দেবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত মহাবিশ্বের প্রাণকেন্দ্র রবিমামা। তার রক্তিম আভায় আরো বেশি জাদুময় হয়ে উঠছিলো চারপাশ । ওদিকে পাখীরা ঘরে ফিরে আসছে। অমলতাস রোড যে পাখীদের জন্য একটি ছোট্ট অরণ্য। হাজার হাজার পাখীর বাস এই রাস্তার গাছগুলোতে। তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠছিলো চারপাশ। এমন সময় পৃথ্বী বলে উঠলো, "এতো সুন্দর দৃশ্য আমি আগে কক্ষনো দেখিনি। পাখীরা এতো সুন্দর করে গান গাইতে পারে, না শুনলে হয়ত জানতেই পারতাম না।" "কেন? আপনার শহরে বুঝি পাখীরা গান গায় না?" "গায় তো। রোজ সকালে চড়ুইপাখি কিচিরমিচির শব্দ করে ভরিয়ে তোলে ইট-পাথরের দালানবাড়িগুলোকে। কিন্তু, সেই চার দেয়ালের ভেতরে বসে সেই গান শোনা আর এরকমভাবে খোলামেলা পরিবেশে, গাছতলায় বসে অসংখ্য পাখীর কিচিরমিচির ডাক শোনার মধ্যে পার্থক্য আছে না?" "তা তো অবশ্যই আছে।" "আচ্ছা, এই রাস্তায় শুধু এই হলুদ ফুলেরই গাছ কেন?" "কেন? হলুদ ফুল পছন্দ নয়?" "না, তা নয়। এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।" "এই ফুলগুলোর নাম অমলতাস। অনেক আগে একজন বৃক্ষপ্রেমিক এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। তাঁর বোধহয় এই অমলতাস ফুল প্রিয় ছিলো। তাই শুধু এই গাছই লাগিয়েছেন।" "ওহ।" "অমলতাস ফুলের আরো অনেক নাম আছে জানেন?" "জানি। সোনালু, বাঁদরলাঠি। ইংরেজি নাম, Golden Rain Tree । বৈজ্ঞানিক নাম, Cassia fistula । " "বাহ! অনেক ধারণা আছে তো আপনার! " "গাছপালা নিয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ।" "হুম। " " এই গাছ থাইল্যান্ড এর জাতীয় গাছ এবং এর ফুলও থাইল্যান্ড এর জাতীয় ফুল।" "তাই নাকি? জানতাম না। ধন্যবাদ জানানোর জন্য। " পৃথ্বী আবারও হাসলো। রাহী বললো, "আপনার হাসি অমলতাসের পাপড়ির মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ। দেখলেই মন ভরে যায়।" পৃথ্বী বোধহয় এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বসে রইলো। তার ঠোঁটের কোণে কেপে উঠছিল মৃদু হাসি। রাহী আরো বেশি মুগ্ধ হলো সেই লজ্জামাখা হাসি দেখে। সে অনেক গল্পে পড়েছিলো, লজ্জা পেলে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। আজ তার প্রমাণ সে পেয়ে গেল। তবে পৃথ্বী যাতে অস্বস্তি বোধ না করে সেজন্যে লজ্জা বাড়ানোর মতো আর কোনো কথা রাহী বললো না। দুজনে উঠে প্রস্থান করলো বড় গাছটার তল থেকে। রাস্তার একপাশ দিয়ে দুজনে ধীরেধীরে হাটছে আর ছোটছোট বিষয় নিয়ে কথা বলছে। বাতাসের ঢেউয়ে অমলতাসের পাপড়ি এসে ঝড়ে পড়ছিল তাদের চারপাশে। প্রকৃতি যেন হলদে ফুলের বাহার ছড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলো এক নতুন প্রেমের গল্পকে। হঠাৎ শোনা গেলো পৃথ্বীর নাম ধরে কেউ আওয়াজ দিচ্ছে। তখন পৃথ্বীর খেয়াল হলো যে তার কাজিন নৈরিতা তাকে রেখে কোথাও চলে গিয়েছিলো। হয়ত সে ফিরে এসে তাকে খুঁজছে। সত্যিই তাই। পৃথ্বী নৈরিতার কাছে গেলো। রাহীও ছিল সাথে । রাহী এবং নৈরিতাকে একে অপরের পরিচিত। রাহীর বন্ধু আকাশের বান্ধবী সে। তার মানে নৈরিতা আকাশের সাথে দেখা করবার জন্যই পৃথ্বীকে রেখে গিয়েছিলো। যাক এব্যাপারে রাহী কোনো কথা তুললো না। কেবল নৈরিতার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমিভরা একটি হাসি দিলো। নৈরিতা কী বলবে বুঝতে না পেরে রাহীকে বিদায় জানিয়ে পৃথ্বীকে নিয়ে বাড়ির পথে চললো। যাওয়ার সময় একগাল হাসি দিয়ে পৃথ্বী রাহীকে বিদায় জানালো এবং বললো, " দেখা হবে।" রাহী সাথে সাথে বলে উঠলো,"হতেই হবে।" পৃথ্বী চলে যাবার পর রাহী আবার বড় গাছতলায় গেল। বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। সন্ধ্যাতারা ঝিকিমিকি করে জ্বলে উঠছে পশ্চিমাকাশে। রাহীর মনে অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজ করছে আজ। এই অমলতাস রোড তার জীবনের অনেক ঘটনারই সাক্ষী। হয়ত, এবার এই পথ তার ভালোবাসারও সাক্ষী হতে চলেছে। রাহী আজ ভীষণ আনন্দিত। ভীষণ। রাহীর আনন্দে আনন্দিত হয়ে যেন অমলতাসের পাতাগুলোও বাতাসের সুরে সুর মিলিয়ে ধরলো এক নতুন গান। পাতার গান, বাতাসের গান, প্রেমের গান। সুরে সুরে আজ মুখরিত অমলতাস রোডের সন্ধ্যাকাল।

ছবি
সেকশনঃ গল্প
লিখেছেনঃ কুহকীনি তারিখঃ 08/01/2017
সর্বমোট 8114 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন