বিদ্রোহী কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরাণিক রূপকের ব্যবহার এতোটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রূপকের প্রয়োগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতোটা দখল ছিল।
*
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
ব্যাখ্যা:
'বল বীর' বলতে কবি পরমাত্মাকে বুঝিয়েছেন এবং এই কবিতায় "আমি" শব্দটি ব্যক্তিক নয়, সামষ্টিক; পরাধীন জাতির প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই "আমি" প্রযোজ্য।
'নেহারী' আরবি নেহার শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ ভোর। 'শিখর হিমাদ্রী' মানে হিমালয়ের চূড়া। কবির ভাবনায় পরাধীন হলেও এই জাতির অবস্থান এতোটাই উপরে যে, ভোরের হিমালয়ের চূড়াও তার কাছে মাথা নত করে।
ভূলোক মানে পৃথিবী, দ্যুলোক মানে স্বর্গ, আর গোলক মানে বিষ্ণুলোক, স্বর্গের যেখানে বিষ্ণু বা কৃষ্ণ বসবাস করে। কৃষ্ণ-রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত। ঋগ্বেদে 'রুদ্র' বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের 'থর' এর মতো। ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন। ইনি ব্রহ্মার পুত্র। তার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী।
রুদ্র হলেন একজন ঋগ্বৈদিক দেবতা, যিনি বায়ু বা ঝঞ্ঝার দেবতার সাথে সংযুক্ত, এবং শিকারের দেবতা। রুদ্র নামটিকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'গর্জনকারী'। ঋগ্বেদ এ, রুদ্রকে "অমিত ক্ষমতাশালী" হিসাবে অর্চনা করা হয়েছে। কবির ললাটে সেই রুদ্র ভগবান জ্বলে যেন সে সবকিছু ছিন্ন করে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছেড়ে অগ্রসর হয়ে খোদার আসন আরশ ভেদ করে একেবারে শীর্ষে অবস্থান নিতে পারেন।
জয়শ্রী হলো জয়ের লক্ষ্ণী, কবির কপালে যেন সেই জয়লক্ষ্ণী রাজটিকা আছে সেকারণে তিনি বিজয়ী হবার ব্যাপারে ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী।
*
বল বীর-আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
ব্যাখ্যা:
মহাদেব বা শিব মহাপ্রলয়ের সময় তাণ্ডব নৃত্য নেচেছিলেন, গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তাণ্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তাণ্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়।
পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যানার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
ব্রিটিশরা আমাদেরকে বস করে পৃথ্বীর মতো কল্যানার্থে যে দেশ কায়েম করেছে কবি তার জন্য অভিশাপ হয়ে দেশকে মুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
-চলবে...