ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

জীবনের গল্প, সবার চেয়ে আলাদা

অতি সাধারণ এক মানুষ আমি। জন্মও আমার এক সাধারণ পরিবারেই, ঊনপঞ্চাশ বছর দুই দিন আগে হয়েছিল তা। কিন্তু আমার জন্মদিনটি সবার মতো নয়, বরং একদমই আলাদা। বলা যাক সে গল্পটি। জীবনের গল্প।

বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ছয় দফা আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়নি তখনও, কয়েকমাস বাকী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন রীতিমত উত্তপ্ত। তবে জাতীয় রাজনীতির সে উত্তাপ তেমন ছড়ায়নি মুক্তাগাছার মোগলটুলা গ্রামে। সে গ্রামের বাসিন্দারা গ্রাম্য আর পারিবারিক রাজনীতি নিয়েই ছিলেন যেন বেশী সন্তুষ্ট। তেমন একটি পারিবারিক রাজনীতির শিকার এক গ্রাম্যবধু বকুল তাঁর আটাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ষষ্ঠ সন্তানের মা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নোংরা পারিবারিক রাজনীতির আঘাতগুলো তাকে তেমন স্পর্শ করতে পারছেনা। তিনি বিভোর হয়ে আছেন আপন সংসারে পা দেয়ার স্বপ্নে। গত এগারটি বছর এ স্বপ্ন দেখা যায়নি। সরলমতি গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুল মাস্টারের স্ত্রী হয়ে এজাতীয় স্বপ্ন দেখা যায়না। তিনি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষাটুকু শেষ করতে না পারলেও সন্তানদেরকে গড়ে তুলতে চান মানুষের মতো মানুষ হিসেবে। তাঁর চেষ্টাতেই স্বামীপ্রবর মোগলটুলা গ্রামের ’ময়নদ্দি মাস্টর’ (মঈন উদ্দিন খান) আজ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে সরকারী চাকরিটি পেলেন। পোস্টিং হলো নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া থানায়। কাজে যোগ দিয়েই তিনি চিঠি লিখলেন সন্তানদের নিয়ে বকুলকে চলে আসতে। ভাবলেন না স্ত্রীর অত্যাসন্য প্রসবকালীন জটিলতার বিষয়টি। অনিচ্ছায় নয়, ভাবতে জানেন না আসলে!

সাতপাঁচ ভেবে দৃঢ়চেতা বকুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যাওয়ার। কিন্তু চাইলেইতো আর হয়না। যাবেন কিভাবে? গ্রাম্য এক হতভাগ্য গৃহবধূ ছাড়াতো কিছু ছিলেন না তিনি। টাকা-কড়ি কিছুই সাথে নেই, কখনও ছিলোওনা। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে পঁয়ষট্টি টাকা ধার করা সম্ভব হলো একটি পালিত বাছুর ও ছাগলের বিনিময়ে। যাওয়ার টাকা নাহয় হলো জোগাড়, কিন্তু সাথে কে যাবে সে প্রশ্নটি সামনে চলে এলো। দয়ার সাগর এক মামা-শ্বশুর বৌমাকে শরীরের এ অবস্থা নিয়ে একা কোনভাবেই ছাড়লেন না। দায়িত্ববান কোন একজনকে খুঁজতে লাগলেন। অনেক খুঁজে পেতে সতের পেরুনো এক ছেলেকে পাওয়া গেল, সম্পর্কে ভাতিজা, যে কিনা সম্প্রতি কেবল ময়মনসিংহ শহরটি চিনেছে কলেজে ভর্তি হওয়ার সুবাদে। জগতের বাকী সব জায়গা তার অচেনা। এই অপ্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্ববান ছেলেটির হাতে (আসলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতেই) আসন্নপ্রসবা বকুলকে ছাড়া হলো। তার সাথে "ডিফল্ট" হিসেবে লেগে থাকল সাড়েতিন থেকে দশ বছর বয়স সীমার চার চারটি শিশু। শুরু হলো যাত্রা, প্রায় অজানার পথে!

সেসময় যশোরে যাওয়ার জন্য ট্রেনই ছিল সুবিধাজনক, একবার টিকেট কেটেই চলে যাওয়া যেত। মাঝে যমুনা পারাপারও হতো সে টিকেটেই। লঞ্চে মাঝ যমুনার অপরূপ সৌন্দর্য তিনি একদমই উপভোগ করতে পারলেন না। বরং তীব্র এক আতংক ঘিরে ধরল তাকে। মা হওয়ার অভিজ্ঞতা তার ভালই আছে। সন্তান হওয়ার আগের লক্ষণগুলো পরিষ্কারভাবেই টের পাচ্ছিলেন তিনি। বকুল একমনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করলেন। ইউনুস নবীর বিপদ এরচেয়ে অনেক বেশী ছিল। মাছের পেট থেকে আল্লাহ্ তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন এই দোয়ার কারণেই। বিপদে-আপদে এই দোয়ার উপর তাঁর অনেক ভরসা। দোয়া ইউনুসের জন্যেই হোক অথবা অন্যকোন উছিলায়ই হোক সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় তারা কোন অঘটন ছাড়াই পরদিন ভোরে পৌঁছলেন যশোহর। সেখান থেকে বাসে নড়াইল হয়ে লোহাগড়া পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল আসল মানুষটিকে। বকুলকে তিনি নিয়ে গেলেন সদ্য বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারী কোয়ার্টারে। অগোছালো বাসাটিতে উঠেও সবাই যেন দিগ্বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে লাগল। গোছগাছ আর আনন্দের মিশেলে বকুল নিজের শারীরিক বাস্তবতা আর বলতে চাইলেন না। বরং সব বেদনা দাঁত কামড়ে সহ্য করে সবার আনন্দের সাথী হয়েই থাকলেন। আহা সন্তানদের এ আনন্দটুকু এতদিন দেয়া যায়নি, থাকুক মেতে ওরা আনন্দে। রাতে সবাই খেয়ে ঘুমালে বকুলের সুযোগ হল স্বামীপ্রবরের সাথে দরকারি কথাটি তোলার। 'কাছেপিঠে এমন কেও কি আছে যার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে?' বকুলের কৌতূহলে জানা গেল, একজন পুলিশের কথা যিনি সস্ত্রীক থাকেন কাছেই। আর সবাই ব্যাচেলর।

ভোর পাঁচটায় ইন্সপেক্টর সাহেবকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন বকুল সেই পুলিশের বউকেই ডেকে আনতে, অন্তত একজন নারীতো থাকবেন পাশে। শরীরের ওই অবস্থাতেই সন্তানদের জন্য নাস্তার আয়োজন করলেন, সাথে নিয়ে আসা চিড়া, নারিকেল আর গুড়ের সহজ নাস্তা। খাওয়া শেষে থালা-বাসন মেজে রাখলেন আর ঘরটাও ঝাড়ু দিয়ে রাখলেন তিনি। নাস্তা খেয়ে সেই ভাতিজা ছোট ভাইদের নিয়ে এলাকা ঘুরে দেখতে বের হল। ততক্ষণে মাসউদার অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাহসও কমে আসছে দ্রুত। কাকে জানাবে সে এ অবস্থার কথা, কাউকেইতো চিনেনা নতুন জায়গায়। নিজের অবস্থার সাথে যুদ্ধে যখন সে প্রায় পরাজিত ঠিক তখন দরজায় জড়োয়া গহনা ও দামী শাড়ি পরিহিতা কমবয়সী এক মহিলাকে দেখা গেল, এসেই সালাম দিলেন। কিন্তু বকুলের তখন সেই মহিলার পরিচয় নেয়ার মত অবস্থা নেই। কোনভাবে সেই মহিলার হাতে নিজের ঘরে পড়ার একটা শাড়ি তুলে দিয়ে দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। এর ঠিক পনের মিনিটের মাথায় কোন ধাত্রী বা সাহায্যকারী ছাড়াই একটি নতুন শিশু পৃথিবীর আলো দেখল।

কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ অচেতন হয়েছিলেন বকুল। জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলেন সেই কমবয়সী মহিলাটি প্রচণ্ড ভীত আর অসহায়ভাবে বকুলের মাথায় হাত রেখে স্থবির হয়ে বসে আছে। সে তার করনীয় বুঝতে সম্পূর্ণ অপারগ, যেন সে স্বপ্ন দেখছে কোন। বকুল তার মুখের দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ভাল আছেন। ততক্ষনে বাইরে নতুন হাসপাতালের অল্প কিছু কর্মচারীকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আনাগোনা করতে দেখা গেল, একজন আয়া এসে শিশুর নাড়ি কাটা ও পরিচর্যার দায়িত্ব নিলো। ডাক্তারও এলেন, বকুলের নাড়ী পরীক্ষা করে খুশী হয়ে উঠলেন, সব ঠিক আছে, কোন ভয় নেই আর। অন্য সন্তানদের মাঝে কেও কাঁদছে আবার কেউবা হাসছে, এর সাথে নতুন শিশুটির দুর্বল আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চারপাশের নানান ধরনের শব্দের মিশেলকে বকুলের কাছে মনে হতে লাগল ছন্দপতনহীন এক সমবেত সংগীত।

বকুল, যিনি নিতান্তই আটপৌরে জীবনের একজন অতি সাধারণ নারী, তিনি জানতেও পারলেন না নবীন এ শিশুটির জীবনে তিনি হয়ে উঠলেন এক অসাধারণ জননী, আর বড় হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই তার জন্মদিনটিকে সে এভাবে স্মরণ করবে। এবং অনন্যসাধারণ মার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে!

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ একটু স্বপ্ন তারিখঃ 20/12/2014
সর্বমোট 1684 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন