পোড়া মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, একটি পুরাতন বাড়ি।বাড়িটির সম্পূর্ণ ইতিহাস না জানলেও, কিছু ইতিহাস সবারই জানা।
কফিলউদ্দিন সরকারের বাড়ি কিন্তু ভুল করে কেউ কেউ কফিল ঠাকুরের বাড়ি বলে থাকে। যা অদৌ ঠিক নয়।
তাহলে কফিল ঠাকুর আবার কে? সবারই জানার ইচ্ছা।
আচ্ছা বলছি তাহলে কে এই কফিল ঠাকুর?
সমাজের মানুষ তাকে কুসীদজীবী বলে ডাকে আর নরনারী ভোগকারী একজন চামড়াখোর হিসাবে পরিচিত।
বিষয় সম্পত্তি অটল থাকার কারণে তার চারিত্রিক গুণাবলী বেপরোয়া হয়ে যায় ;এই হালফিল যুগে, যে চিত্রটি আমরা সচরাচর দেখতে পাই।তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
দরিদ্র কৃষকগোষ্ঠী শস্য উৎপাদন বা আর্থিক অনাটনের কারণে, এই কফিল ঠাকুরের কাজ থেকে চড়া সুদে নগদ তারল্য নিয়ে আসতো চার/পাঁচ মাসের জন্য।
এই যুগে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা নামে যেগুলো সুদের ব্যবসাকে বৈধতা বলে চালিয়ে আসছে তাদেরই একটি কল্পচিত্র।
সমাজ থেকে সেই কফিল বিদায় হলেও, হাজার ও কফিল এখনো সমাজে বিরাজ করছে। আমরা কখনো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না বরং নতুন আরেকটি অনৈতিক ইতিহাস তৈরি করি। সমাজে নিজের অস্তিত্ব কে টিকে রাখার জন্য। এই জন্য কফিলদের মৃত্যু হয় না।
কফিলউদ্দিন সরকারের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বেশ কিছুদিন আগে এখানে পরিবার পরিকল্পনার অস্থায়ী অফিস ছিল কিন্তু যে কোন কারণ বশত অফিসটি এখান থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে।
বাড়িটির সামনে বিশাল একটি কংক্রিট দ্বারা গেইট আছে যা প্রাচীন যুগে রাজাদের বাড়ির মত।
সেই গেইট এর একপাশে বড় করে লেখা আছে "মস্তিষ্কই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম"
দ্বিতল বিশিষ্ট প্রাসাদ টি সামনের অংশটুকু সরোবর এবং দুই পাশ দিয়ে সরু রাস্তা যা উভয় রাস্তা দিয়ে প্রাসাদে মেইন দরজায় প্রবেশ করা যায়।
রাস্তার সাথে নানারকম ফল ও ঔষধি গাছ লাগানো আছে। আর মেইন দরজার পাশেই একটি পুষ্প বাগান ছিল কিন্তু এখন আর আগের মত ফুল গাছ নেই। গ্রামের ছেলেদের অত্যাচারে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
থাকবেই বা কি করে? তত্ত্বাবধান না থাকায় ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
আবর্জনাপূর্ণ বাড়িটিতে মানুষের আনাগোনা কম থাকলেও বালকেরা বিকাল বেলা এসে আড্ডা দেয়, পাশাপাশি আম,জাম,কাঠাল,ডাব ইত্যাদি পেড়ে মনের আনন্দে ভক্ষণ করে।
মালিক না থাকলে যা হয় আর কি?
ভাল ছেলেরা দিনে বেলায় থাকে, রাতে যাদের কাজ তারা রাতে এসেই সমাধান করে যায়। বলার কেউ না, যাচ্ছেতাই করতে পারে সবাই।
একদিন ঠিক দুপুর বেলা!
জাবিদ ও সুমন বাড়িটিতে প্রবেশ করলো হালকা বাতাসে মনটাকে রিফ্রেশ করার জন্য। তারা প্রতিদিন যেখানে আড্ডা দেয় সেখানে এখন প্রচণ্ড রোদ তাই একটু সামনে পিয়ারা গাছের নিচে গিয়ে বসবে বলে হাটতে শুরু করলো।
পিয়ারা গাছের সামনাসামনি গিয়ে তারা একটি কাপড়ে মোড়ানো বাচ্চা দেখতে পায়।
তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দৌড় দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ;মেইন সড়কে উঠতেই ফরিদ চাচা সাথে দেখা।
ফরিদ চাচা তাদের হাঁপাতে দেখে বলল', কি হয়েছে তোদের?
জাবিদ আমতাআমতা করে বলল", চাচা ঐ বাড়িতে একটি বাচ্চা পড়ে আছে আমরা দুজন দেখে ভয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসলাম।
"ফরিদ চাচা একটু চিন্তা করে বলল",চলতো দেখে আসি?
ফরিদ চাচা সাথে বাড়িতে ঢুকে, সেই পিয়ারা গাছের নিচে নিয়ে তাকে দেখালাম কাপড়ে মোড়ানো কিন্তু পায়ের একটু অংশ বের হয়ে আছে। চাচা কাছে গিয়ে বলল", জাবিদ দেখ বাচ্চাটি নড়াচড়া করছে, মনে হয় বেঁচে আছে।
এই বলে চাচা হাত দিয়ে ছেলেটিকে তুলে আনলো। আমরা তো দেখে অবাক! এতো সুন্দর একটি ছেলে কে কেউ ফেলে যায় নাকি?
চাচা ছেলেটিকে নিয়ে বাড়িতে আসল।
এই খবর নিমিষের মধ্যেই, গ্রামের সকল মানুষ জানাজানি হয়ে গেল যে একটি বাচ্চা পাওয়া গেছে সেই প্রাচীর ঘেরা বাড়ি থেকে।
ফরিদ চাচার বাড়িতে মানুষের ভীড় জমে গেল নিমিষের মধ্যেই।
সবাই দেখে কানাঘুষা করতে লাগলো, এটা জারজ সন্তান। অবৈধ মেলামেশা করে বাচ্চা হয়েছে কি আর করবে? হয়তো কোন আলালের ঘরের দুলালের কাজ। মানুষ দেখছে আর এই কথাগুলোই বলছে।
মেম্বার, চেয়ারম্যান এসে দেখে গেল এবং বলল আমি দেখতেছি এটা কার শিশু। আপাতত ফরিদের বাসায় শিশুটি থাকুক।
অনেক দিন হয়ে গেল, এই শিশুটির কোন পিতৃ পরিচয় পাওয়া গেল না।
শিশুটি পিতৃ পরিচয়হীন ভাবে বেড়ে উঠতে লাগলো ফরিদের বাসায়।
সমাজের মধ্যে পিতৃহীন পরিচয়ে বেড়ে উঠা মানে, জন্মই আজন্ম পাপ।
সমাজের মানুষ কখনই তাকে ভাল রূপে গ্রহন করবে না এমন কি রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নেবে না।অথচ কী দোষ ছিল কোমল শিশুটির?
কী অপরাধ ছিল এই অবুঝ শিশুটির?
যার জন্য সারাটি জীবন তাকে এই গ্লানি বহন করে চলতে হবে। যে পাপ কাজটি করেছে তার কোন শাস্তি এই সমাজ দিল না। শুধু শাস্তিটি মাথায় নিয়ে এই অবুঝ শিশুটিকে চলতে হবে সারাটি জীবন।