এক।
মেঘদল ২০০২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একটি ব্যান্ড দল। ফরাসি কবি বোঁদলেয়ারের কবিতা থেকে মেঘদল নামটি নেয়া হয়েছে। ব্যান্ডের ৭জন সদস্য- ভোকাল শিবু কুমার শিল ও মেজবা-উর রহমান সুমন, গিটারিস্ট ভোকাল রাশিদ শরীফ শোয়েব, বেজ গিটারিস্ট এম জি কিবারিয়া, ড্রামস আমজাদ হোসেন, কীবোর্ড তানভীর দাউদ রনি ও বাঁশি সৌরভ সরকার। এ পর্যন্ত তাদের ২টি স্টুডিও অ্যালবাম বের হয়েছে; তৃতীয় অ্যালবামের কাজ চলছে।
১১০ মাস আগে মেঘদল ব্যান্ড একটি গান গায় যেখানে হজের সময় উচ্চারিত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ শব্দগুলো আছে।
ইমরুল হাসান নামের এক আইনজীবী ২৮ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মেঘদলের ৭ জন সদস্যকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ করেছে যে, ২৬ অক্টোবর বাসায় অবস্থানকালে সকাল ৭টার দিকে তিনি ইউটিউবে দেখতে পান যে, গানের তালে হজের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিকে নিষিদ্ধ বাদ্য বাজনা তথা আধুনিক মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে বিকৃত সুরে গান আকারে অশ্রদ্ধার সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাতালের ন্যায় গাওয়া হচ্ছে। এই ধ্বনিকে গানের মধ্যে বিকৃতভাবে তুলে ধরায় তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনেছেন।
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়- এ দোয়া প্রতিটি মুসলিমমের কাছে বিশুদ্ধ ও পবিত্র। এ দোয়া বা প্রার্থনা সাধারণত হজের সময় বিনয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধাভক্তি দিয়ে পাঠ করা হয়। গানের অনুষ্ঠানটি টিএসসিতে ভাস্কর্যের সামনে করা হয় এবং পেছনে সাইনবোর্ড আকারে লেখা ছিল সহিংসতা। গানের মধ্যে আরও দেখা যায় যে, মুসলমানদের পবিত্র কালিমার অংশও গানের তালে পাঠ করা হয়।
৩১ অক্টোবর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলাম পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে এই মামলার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। পিবিআইকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ১ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করায় আইনজীবী ইমরুল হাসান কদমতলী থানায় মামলা করতে যান। থানা কর্তৃপক্ষ মামলা গ্রহণ না করে তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন।
দুই।
মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলার কয়েকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় জেনে নেওয়া যাক।
১। আইনজীবী ইমরুল হাসান ইতোপূর্বে ধর্মানুভুতিতে আঘাত পাওয়ার কারণে বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জিয়ায়ুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। উনার ধর্মানুভুতিটা একটু বেশিই নরম। নিজ পেশায় লাইমলাইটে আসার প্রচেষ্টায় উনি এগুলো করছেন বলে মনে হয়।
২। এজাহার অনুযায়ী তিনি ২৬ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মেঘদলের গানটি শোনেন, অথচ এর ১১০ মাস আগে এই গানটি গাওয়া হয়। তিনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?
৩। তিনি এজাহারে লিখেছেন কনসার্টের নাম ছিল "সহিংসতা কনসার্ট ", অথচ ওই কনসার্টের নাম ছিল "সহিংসতা বিরোধী কনসার্ট"। শিরোনাম বিকৃত করে উনি কোন ফায়দা আদায় করতে চান?
৪। এজাহারে তিনি লিখেছেন, এই গান শুনে সাধারণ মানুষ "উত্তেজিত" হয়ে পড়ে। গান শুনে উত্তেজিত হওয়া তো গানের সফলতা। ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাওয়ার কারণে তো কেউ উত্তেজিত হয়নি।
৫। এজাহারে চার নম্বর পয়েন্টে তিনি সমগ্র গান-বাজনাকেই নিষিদ্ধ উল্লেখ করেন। তাহলে অভিযোগ কার বিরুদ্ধে, মেঘদল ব্যান্ড না কি পুরো সংগীত জগত?
তিন।
১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত; ফারুক, ববিতা অভিনীত নয়ন মনি সিনেমায় গাওয়া আব্দুল হাদীর "কোন কিতাবে লেখা আছে গো হারাম বাজনা গান" এটি ছিল গান বাজনা হারামের বিষয়টি নিয়ে তখনকার একটি ওপেন চ্যালেঞ্জ। নয়ন মনি ছবিটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এর প্রতিটি গান যেমন- আমি কোথায় থাকি রে বট গাছের পাতা নাইরে, চুল ধইরো না খোপা খুলে যাবে হে নাগর।
"কোন কিতাবে লেখা আছে গো হারাম বাজনা গান" এই গানটির মাধ্যমে যে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শরিয়ত সরকার বয়াতিকে এরকম একটি চ্যালেঞ্জের কারণে গ্রেফতার করা হয়।
শরিয়ত বয়াতি ঢাকার ধামরাই এলাকায় এক অনুষ্ঠানে গানের আগে বক্তব্যে বলেছিলেন, গান-বাজনা হারাম বলে ইসলাম ধর্মে কোনো উল্লেখ নেই। কেউ প্রমাণ দিলে তিনি গান ছেড়ে দেবেন। তার এই ওপেন চ্যালেঞ্জের পরে যদিও হাদিস-কোরআনের সুনির্দিষ্ট কোনো রেফারেন্স নিয়ে কেউ হাজির হয়নি তারপরেও তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
১৯৭৭ সালে সিরাজুল ইসলাম সিরাজ পরিচালিত, শাবানা, বুলবুল আহমেদ অভিনীত জননী ছবিতে জানে আলমের গাওয়া "মানুষও বানাইয়া খেলছ যারে লইয়া সেই মানুষও কেমনে গুনাগার" গানটিও ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই গানটির কথায় আছে- "তুমি চোরেরে কও চুরি করো, গৃহস্থরে কও ধরো ধরো, বুঝেছি বুঝেছি তুমি চোরেরও সর্দার গো..."।
মওলাকে সরাসরি চোরের সর্দার বলার কারণে সেই ১৯৭৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগেনি। অথচ ইদানীংকালে একটুতে একটু কিছু হলেই ধর্মানুভূতিতে আঘাত পেয়ে হিংস্র হতে দেখা যাচ্ছে। কেন? দিন দিন মানুষ ধর্মপ্রাণ হচ্ছে এমন তো নয়, বরং তার উল্টোটাই হচ্ছে।
এখন বইমেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল দিয়ে বই চেক করে দেখে কোনো বইয়ের কোথাও ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাওয়ার মতো কিছু লেখা আছে কি না। একটা বইতে তাদের বিবেচনায় এরকম কিছু থাকার কারণে পুরো প্রকাশনাটির বইমেলায় স্টল বাতিল হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।। লেখককে এখন এসব ধর্মের ধ্বজাধারীদের মতামত নিয়ে লিখতে হবে এবং মত প্রকাশ করতে হবে!
ধর্মানুভুতিতে আঘাত পাওয়ার অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রোশ ঝাড়া একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো এমনি এমনি হচ্ছে না, এর পেছনে সূক্ষ্ম কারণ আছে, এটিকে করানো হচ্ছে।
সম্ভবত জ্যোতি বসুর একটি বাণী আছে এরকম- শাসক না চাইলে সেই সমাজে ধর্মীয় হানাহানি হয় না।
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে সমাজকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে যদি এই দাবি ওঠে- জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে ইসলামী সংগীতকে জাতীয় সংগীত করতে হবে এবং বাজনা তুলে দিতে হবে, তাহলে সেটাতেও আশ্চর্য হবার মতো কিছু থাকবে না। মনে রাখা দরকার যে, ধর্মীয় সমাজ কখনো মানবিক সমাজ হয় না।