তবুও শেখ হাসিনাই থাক
সাইয়িদ রফিকুল হক
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ মূলত ও কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। এইসময় কোথাও-কাউকে নেতা হিসাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও যে সেই সময় নেতা বলে কেউ ছিল না—তা নয়। তবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশ্বস্ত চারনেতার আদর্শের পতাকাবাহী নেতা হওয়ার মতো কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া তখন থেকেই মুশকিল ছিল। তবুও সেই সময় আওয়ামীলীগের একশ্রেণীর নেতা জিয়াউর রহমানের কঠোর সামরিক শাসনের সময় দলের নেতৃত্বে হালধরে ছিলেন—যাতে সামরিক-সরকার আওয়ামীলীগকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলতে না পারে। তাঁরা কিছুটা সক্ষম ছিলেন বলেই সামরিকজান্তা জিয়াউর রহমানের সামরিক-নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এগুলো এখন ইতিহাস। এবিষয়ে এতোকিছু বলার তেমন-কোনো প্রয়োজনও নাই। এসব শিক্ষিতমাত্রেই জানে।
দেশে ফিরে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলেন। দলকে নতুন করে যেন গোছাতে শুরু করলেন। জিয়াউর রহমানের সামরিকমন্ত্রবলে ঐতিহাসিক আওয়ামীলীগকে তিনটুকরা করা হয়েছিল। তিনটুকরা আওয়ামীলীগকে জোড়াতালি দিয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) এক পিসে বা একটুকরায় পরিণত করলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী-সংগঠন আওয়ামীলীগ যেন আবার তার প্রাণ ফিরে পেল। শুধু আওয়ামীলীগ নয়—সেই সময় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় জিয়াউর রহমানের সামরিক-শাসনবিরোধী সর্বস্তরের রাজনৈতিক দলে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো।
এরপর জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হলো ১৯৮১ সালের ৩০-এ মে। জিয়ার মৃত্যুর পরে ‘বিএনপি’র অমেরুদণ্ডী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ভয়ে হোক আর নিজের ব্যর্থতায় হোক—আরেক সামরিক শাসক লে.জে.হো.মো. এরশাদের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করলো—১৯৮২ সালের ২৪-এ মার্চ। বাংলাদেশে আবার শুরু হলো সামরিকশাসন-নামের রাষ্ট্রবিরোধী-অপতৎপরতা।
এরশাদবিরোধী-আন্দোলনেও শেখ হাসিনা থেকেছেন সবার আগে। তিনি মনেপ্রাণে এরাশাদবিরোধী আন্দোলনও করেছেন। আবার সময়ের প্রয়োজনে এরশাদকে ক্ষমতার পাশেও রেখেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেককিছু করতে হয়। তিনি বাংলাদেশরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অনেকের সঙ্গে আপসও করেছেন।
২০০৮ সালের ২৯-এ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর থেকে বর্তমানে আওয়ামীলীগ একাধারে তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। সেই হিসাবে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রীও শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর অবশ্যই সফলতা, ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটা বাংলাদেশ। আর বাঙালি কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে শংকর-জাতি!
এই জাতিকে সন্তুষ্ট করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের মানসিকতা এখনও ইউরোপের মতো হয়নি। কিন্তু আমরা দেশের শাসকবর্গকে দেখতে চাই ইউরোপ-আমেরিকার মতো! জাতি হিসাবে আমরা আসলে স্ববিরোধী। নিজে যা—তা অন্যের ভিতরে দেখতে চাই না। আর নিজে যা না—তা-ই অন্যের ভিতরে দেখতে চাই। এজন্য এদেশের পরকীয়ায় আসক্ত স্বামীবর্গ খোঁজে সতীসাধ্বী স্ত্রী আর পরকীয়ার রাণীরা খোঁজে সৎ ও সজ্জন পুরুষ! আমরা ঢাকার মিরপুরের ‘ক অক্ষর গোমাংস’ এস এ খালেককে ভোট দিই—আবার মুখে বলি সুশাসন! খালেকের মতো একটা অকাটমূর্খ কীভাবে আইনসভার সদস্য হতে পারে? আমরা এর কোনো বাছবিচার করি না। ভোট দেওয়ার সময় চোখকান বন্ধ করে ভোট দিই। কিন্তু কথা বলার সময় ইউরোপের আইনসভার সদস্যদের মতো কথা বলি! আমরা ‘হাজী সেলিমে’র উত্থান দেখেছি। এরও কারণ আমাদের সমাজের রাজনীতিতে সামরিক-শাসন, কালোটাকার উত্থান, অসৎ-লোভী ব্যবসায়ীদের তাণ্ডব, দুঃশাসন আর নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি সীমাহীন অবহেলা ও ধৃষ্টতা।
কথা বলার সময় আমাদের অনেকের অবস্থা টালমাটাল হয়ে থাকে। নিজের স্বার্থে আমরা অনেকেই সুবিধাজনক কথা বলি। আর নিজের স্বার্থের পরিপন্থী হলে বল্গাহীন আচরণ শুরু করি। দেশটা এজইন্যই আজও বেশি দূরে অগ্রসর হতে পারছে না।
আমাদের দেশে আসলে সুনাগরিকের বড় অভাব। সুনাগরিক কাকে বলে? আমি নিজে কোনো সংজ্ঞা দিতে চাচ্ছি না বলে স্বনামখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইসের একটি উক্তি ধার করছি। তিনি সুনাগরিকের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো—বুদ্ধি, বিবেক ও আত্মসংযম। এদেশের কয়টা মানুষের এই তিনটা জিনিস আছে? কিন্তু কথা বলার সময় একেকজন কতবড় বাক্যবাগীশ হয়ে বসে থাকে! এই দেশটা এখন এমন হয়েছে যে, একটা রিক্সাওয়ালাও দেশের সংবিধান নিয়ে কিংবা সংবিধানবিরোধী কথা বলে! স্পর্ধারও একটা সীমারেখা থাকা দরকার।
শেখ হাসিনা অনেক লড়াইসংগ্রাম করেছেন। তবুও তিনি আওয়ামীলীগটাকে এখনও ধরে রেখেছেন। আর বাংলাদেশটাকে তালেবানী-দুঃশাসন থেকে রক্ষা করেছেন। বারবার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশটাকে শ্বাপদমুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। এখনও লড়াই করছেন নিজদলের অসৎ, লোভী, ক্ষমতালোভী, আর মোশতাকদের বিরুদ্ধে। আমি শেখ হাসিনার পক্ষে বলছি—তা নয়। আমি ইতিহাসের অমোঘ সত্যটাই শুধু এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমার দৃঢ়বিশ্বাস: শেখ হাসিনা যেকোনোসময় দলের ও সরকারি পদ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি দিবেন কার কাছে? বাংলাদেশে এমন কোনো যোগ্য রাজনীতিবিদ এখন আছে? তাঁর নিজদলে কিংবা অন্যদলে? থাকলে একটা দেখান তো দেখি!
আওয়ামীলীগে এখনও যোগ্যনেতার বড় অভাব। এই বিশাল দলের একজন সেক্রেটারি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এরচেয়ে অবাকবিস্ময়ের আর কী আছে? এখনও আওয়ামীলীগের একজন সেক্রেটারি হওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায় না! তাইলে, শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতাহস্তান্তর করে কার কাছে তার দলের সভাপতির পদ অর্পণ করবেন? আওয়ামীলীগের অনেক নেতাই এখন নিজের স্বার্থে দলের ভিতরে জামাতী, বামাতী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি ঢুকিয়ে দলটাকে ‘হাইব্রিড-লীগে’ পরিণত করতে চলেছে। একা শেখ হাসিনা কতটা লড়াই করবেন এদের বিরুদ্ধে? এই দলের ভিতরে এখনও অসংখ্য খন্দকার মোশতাক বসে রয়েছে। আর এই বিশ্বাসঘাতক-মোশতাকদের হাতে যদি শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের ‘সভাপতি’র পদ ছেড়ে দেন—তাইলে, এরা আওয়ামীলীগকে রাতারাতি ‘জামায়াত-লীগে’ পরিণত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ কিংবা সামান্য বিলম্বও করবে না। তাই, সুধীসমাজের কাছে বলছি, আগে আওয়ামীলীগের ভিতরে একজন সভাপতি-সেক্রেটারি হওয়ার মতো লোক খুঁজে বাহির করেন—তারপর তাঁকে সরে যেতে বলেন। তাছাড়া, অনেকে রাত-দিন বলাবলি করছেন, ‘দলের ভিতরে গণতন্ত্র নাই? দেশে গণতন্ত্র আসবে কীভাবে? দেশে এখন স্বৈরশাসন! দেশটা রসাতলে গেল!’—এইজাতীয় ফাঁকাবুলি তারা দয়া করে আর আওড়াবেন না। এই দেশে কবে-কোথায় এতো গণতন্ত্র ছিল? সৎসাহস, যোগ্যতা আর প্রমাণ থাকলে তার থেকে একটা দেখান তো! আওয়ামীলীগের ‘জাতীয় কাউন্সিল’ হয়ে গেল (মানে, হয়ে যাচ্ছে)! হয়তো নেতৃত্বের তেমন-কোনো পরিবর্তন হবে না! কিন্তু তাই কী? তবুও শেখ হাসিনাই থাক। তবুও বাংলাদেশটা টিকে থাক। শেখ হাসিনার বিকল্প তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তবুও এভাবেই দেশটা এগিয়ে গিয়ে একদিন ইউরোপ-আমেরিকার মতো হয়ে উঠুক। কিন্তু আমরা এই বাংলাদেশে আর কখনো তালেবানী-দুঃশাসন দেখতে চাই না।
জয় হোক বাঙালির। জয় হোক বাংলার সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষের। জয়-বাংলা।
সাইয়িদ রফিকুল হক
২১/১২/২০১৯