জাতীয় সংসদ নির্বাচন ;২০১৮। অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনের চেয়ে এর গুরুত্ব অনেকাংশেই বেশী, বিশেষ করে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোতে। আমাদের দেশে বলতে গেলে সব কিছুই রাজধানী কেন্দ্রিক। সরকার প্রশাসন বিচার ব্যবস্থা শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রায় সবই। রাজনীতিরও মুল কেন্দ্র ঢাকা। বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনা এবং নির্বাহের সিংহভাগ দায়িত্ব সরকার প্রধানের কাছে ন্যস্ত। সাংবিধানিক বলেই সরকার প্রধান রাষ্ট্র ও দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবাদ। গণতান্ত্রিক চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না নেয়ার কারণে এবং প্রচলিত রেওয়াজ অনুসারে এবং ধারাবাহিকভাবে সরকার প্রধান. দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতার দায়িত্ব একই ব্যক্তির উপর ন্যস্ত থাকে। যেকারণে সরকারী দল, সরকার এবং সংসদ কে পৃথকভাবে চিন্তা করার সুযোগও কম। যে কারণে বর্তমান সময়ে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী এবং প্রতিভাবান ও যোগ্য ব্যক্তি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু তনয়া বঙ্গরত্ন দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা। যিনি আওয়ামী লীগের প্রধান, সরকার প্রধান এবং সংসদ প্রধান।
আজকের আলোচনার বিষয় একক ব্যক্তির ক্ষমতা, গণতন্ত্র, কেন্দ্রীভূত অবকাঠানো, ক্ষমতা ও অবকাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ এসব কিছুই নয়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের জনপদ সংসদ নির্বাচনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। একদিকে সরকারের ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়া, বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত মেগা প্রকল্পসমূহ যথা সময়ে সম্পন্ন করা, আইনে শাসন প্রতিষ্ঠা করা, সব দলের সমন্বয়ে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ নির্বাচনকে ঘিরে আনুসঙ্গিক অনেক কিছু।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনা দলগুলোর দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে। দফায় দফায় হচ্ছে আলোচনা, মতবিনিময়, সংবাদ সম্মেলন, টকশোতে বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ ইত্যাদি। সবচেয়ে আলোচনায় এসেছে বিপরীত মেরুতে থাকা যুক্তফ্রন্টকে নিয়ে। যার মুল নেতৃত্বে ডঃ কামাল ও ডঃ একিইউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আরও আছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, খলিফা আসম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। একমাত্র বি চৌধুরী বাদে সবাই প্রাক্তন আওয়ামী লীগার। তারাই নাকি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর একটি দল বিএনপির সাথে ঐক্যজোট করছে নির্বাচনকে সামনে রেখে, যাদের আবার যুদ্ধাপরাধী দল জামাতসহ বিভিন্ন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দলে জনবল এবং গ্রহনযোগ্যতা বিবেচনায় বিএনপির ধারের কাছেও কেউ নেই। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এই এক্যজোট নামক সমঝোতার মাহাত্ম কি?
শক্তি বিবেচনায় বর্তমান আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি খুব কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি জামাত জোটের বেশ কিছু দেশবিরোধী এবং হিংসাত্বক কর্মকাণ্ড এবং জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার কারণে উপরন্তু দলের মুল এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকরা ধ্বংষাত্বক কর্মকাণ্ডসহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, বিরোধী দলীয় নেতা ও দলকে নেতাশুন্য করার লক্ষ্যে হত্যা চেষ্টা ও হত্যা করার কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া বিএনপিকে পিছনে ঠেলে দেয়। ২০০৬ সালে স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। জরুরি অবস্থা জারী করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল। সবচেয়ে বেশী নেতিবাচক দিক ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের পূনর্বাসন করা এবং ক্ষমতার অংশীদার করা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে বিএনপি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ কেন্দ্রিক সৃষ্ট গণজাগরণকে সমর্থণ না দিয়ে ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিতে সমর্থণ যোগায় এবং ১৩-১৪ সালে দেশ জুড়ে পেট্রোল বোমায় যানমাল ধ্বংসে শরীক হয়। রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তাদের পক্ষ্য থেকে নূন্যতম সমর্থন উঠিয়ে নেয়। বিএনপি শীর্ষ নেতারা আদালতের রায়ে দোষি সাব্যস্ত হয় এবং রাজনীতিতে অযোগ্য প্রমানিত হয়।
উপরিউক্ত কারণে বিএনপি নামক প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় দলটি মুল ধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে।
২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মহাজোট শাসনামলে লাখ উন্নয়ন ও অর্জনের মধ্যেও শত শত ব্যর্থতা রয়ে গেছে। যেমন শেয়ার বাজার কেলেংকারী, যেখানে লাখ যুবক তরুণ নিঃস্ব হয়েছে, ব্যাংক জালিয়াতি, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লুপাট হয়েছে, দূর্ণীতি অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারীতা বর্তমান শাসনামলেই হয়েছে। কিন্তু বিগত দশ বছরে বিএনপি নামক দলটি জনগণের পক্ষ হয়ে এই বিষয়গুলো জনসম্মুখে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শীর্ষ নেতারা বিশেষকরে দল প্রধান বেগম খালেদা এবং সহ প্রধান তারেক জিয়া দূর্ণীতির দায়ে যথাক্রমে কারাগারে ও নির্বাসনে থাকার কারণে বিএনপি নামক দলটি অনেকটাই নিঃস্ব এবং নেতৃত্বশুন্য। আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে দলের ভিতর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু না থাকা নেতৃত্ব ও নেতা সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া না থাকার কারণে বেশীরভাগ রাজনৈতিক দল ব্যক্তি ও পরিবার নির্ভর। বিএনপিও জিয়া পরিবার নির্ভর। আর বিএনপির কর্ণধার ত্রাতা জিয়া পরিবার রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত।
বিবদমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ মতাবিনিময় অবশ্য প্রয়োজনীয়। সরকার প্রধান ও আওয়ামী লীগ প্রধান হিসাবে শেখ হাসিনা চেষ্টাও করেছিলেন ২০১৩ সালে। সুশীল সমাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ তাগিদ দিয়ে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরেই। কিন্তু বিএনপির নেতা বেগম খালেদার একগুয়েমি এবং অশালিন আচরণের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তার বিতর্কীত কর্মকাণ্ড এরজন্য অনেকাংশেই দায়ি। ২০০৭-২০০৮ এ মান্নান ভূইয়া- আব্দুল জলিল এবং ২০১৩তে সৈয়দ আশরাফ- ফকরুল ইসলাম চেষ্টা করেছেন রাজনৈতিক অচলাবস্থা আলোচনার মাধ্যমে নিরসনের। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৩তে বেঘম খালেদা শেখ হাসিনার আ্হবানে সাড়া দেননি। বেগম খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কুকোর মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসাবে খালেদাকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন কিন্তু বেগম খালেদা নূন্যতম সৌযন্যতা দেখাননি। উপরন্তু জাতিরজনকের মৃত্যুদিনে বেগম খালেদার ভূয়া জন্মদিন পালন একটি বিষভোড়া। তারপর ১৩-১৪ তে আলোচনায় সাড়া না দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ, দেশজুড়ে পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারা বিএনপির সাথে আলোচনা বা সংলাপের পথ একেবারে রুদ্ধই ছিল। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাদীদের পক্ষ অবলম্বন করা এমনকি সন্ত্রাসী দল হিসাবে জামাত শিবিরের পাশাপাশি বিএনপির জায়গা করে নেয়া, এসব বিবেচনায় সরকার প্রধান ও আওয়ামী লীগের প্রধান হিসাবে বিএনপির সাথে সংলাপ ছিল অসম্ভব এবং অবান্তর ও অবাস্তব।
প্রচলিত আইনে বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে হবে। তাকে জনপদে বের হতে হবে এবং সংগঠিত হতে হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্ব অসহায়। তাদের রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য হলেও একজন ত্রাতা দরকার। বিএনপি নামক দলটি সংগঠিত না হলেও তাদের রয়েছে অঢেল জনবল। আর যেহেতেু বর্তমান রাজনীতিতে দুইটি ধারাই বর্তমান আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ। কিছু শক্তি আছে বিএনপির আদর্শ ধারণ করেনা কিন্তু আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা বিদ্বেষী।
সকল অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক সূচকে দৃশ্যতঃ অগ্রগতি সত্বেও পাবলিক পারসেপশন এন্টি শাসক। পঞ্চাশ ভাগে বেশী নারী এবং মোট ভোটারের কমপক্ষে চল্লিশ শতাংশ যুবক ভোটার। তাদের অনেকেই বর্তমান সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণ পোষণ করে। এটা এন্টি আওয়ামী লীগারদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার না করে নিরপেক্ষ স্বচ্ছ এবং নূন্যতম গ্রহনযোগ্য ভোট হলে মাঠে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি, বিশিষ্টজনদের এটাই ধারণা। দল বিবেচনায় এমনটি হলে ফসল উঠবে বিএনপির গোলায়। একারণেই সম্ভবত বিএনপি নামক শক্তিশালী দলটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ও জনবলহীন ডঃ কামালগংদের নেতা মেনে ঐক্যজোটে সওয়ার হয়েছে। এছাড়া ডঃ কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীদের জোটে রাখবেন না এবং বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা শ্লোগানসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমন্বিত রূপের তকমা সাধারণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন। শাহবাগ গণজাগরণের একটা দাবি ছিল এই দেশে রাজনীতি করতে হলে দলগুলোকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করতে হবে এবং জয় বাংলা শ্লোগান বুকে ধারণ করতে হবে। সত্যি সত্যিই বিএনপি যদি ডঃ কাামালদের সেন্টিম্যান্টের সাথে তাল মিলিয়ে জামাত তোষণের খোলস থেকে বের হয়ে আসতে পারে, তবে বিএনপিসহ ডঃ কামাল গংরা এবং ঐক্যজোট হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে সত্যিকারের পরাশক্তি। বিএনপির পাপমোঁচন হবে এবং দেশ সঠিক রাজনৈতিক দিশা খুঁজে পাবে। জামাতসহ সকল উগ্রধর্মান্ধ বাম শক্তি পরাভূত হবে এবং রাজনীতি থেকে বিতারিত হবে। যদিও একটা সুন্দর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
শীর্ষ নেতাদের জেলে রেখে ডঃ কামালের নেতৃত্বে সরকার প্রধান ও প্রতিপক্ষ দলের প্রধান নেতার সাথে সংলাপের এটাই প্রধান এবং অন্যতম কারন এবং এটাই বিএনপির জন্য রাজনৈতিক স্পেজ বের করার কৌশল এবং প্রাসঙ্গিক।