ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

যানজট, পদ্মাসেতু ও তাজমহল


এক।

# ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা পৌনে দুই কোটি৷ যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় গড়ে যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগে এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।

# ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার, রাস্তার দৈর্ঘ্য ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক৷ সড়কের ৩০ ভাগ বা তারও বেশি অবৈধ দখলদারদের হাতে৷

# ঢাকায় ৯ লাখ ১৩ হাজার ৬২২টি নিবন্ধিত মোটরযান রয়েছে৷ এর মধ্যে বাস ২৩ হাজার ১১৯টি, মিনিবাস ১০ হাজার ৭টি, প্রাইভেট কার ২ লাখ ১৬ হাজার ৭২২টি৷

# বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্ট বা বিওআই-র গবেষণায় বলা হয়েছে যানজটের কারণে বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয় তার মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা৷ এগুলিকে নিম্নোক্ত মোটা দাগে ভাগ করা হয়েছে-
- কর্মঘণ্টা নষ্ট হবার কারণে ক্ষতি, ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা৷
- উৎপাদন খাতে আর্থিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
- স্বাস্থ্যগত অসুবিধা সৃষ্টি হবার কারণে ক্ষতি, ২১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
- জ্বালানি ও যানবাহন মেরামত বাবদ ক্ষতি , ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা।
- দুর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতি ১৫৪ কোটি টাকা৷

# দীর্ঘ মেয়াদে যানজট নিরসনে ঢাকায় ২৯ কিলোমিটারের দীর্ঘ তিনটি উড়াল সড়ক এবং ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল রেল নির্মাণের কাজ চলছে৷ পরিকল্পনাবিদদের মতে- দীর্ঘ মেয়াদে যানজট নিরসনে এগুলোর দরকার আছে কিন্তু যখন এগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে, তখন যানজট নিরসনে এর ভূমিকা তেমন আর লক্ষ্য করা যাবে না৷ কারণ, সে সময়ের মধ্যে লোক সংখ্যা ও যানবাহনও এতোটা বেড়ে যাবে যে এর সুফল বোঝা যাবে না।

# ঢাকার যানজট সংকট নিরসনে স্বল্পমেয়াদে কম খরচে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার ফুটপাথ দখলমুক্ত এবং অবৈধ পার্কিং যদি বন্ধ করা ছিল সে পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু হয়েছে উল্টো; ফুটপাথ এবং সড়কে বাজার বসানো শুরু হয়েছে। কারণ, এতে কারও না কারও হাতে কাঁচা পয়সা আসে।

# আফ্রিকাসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ শুধুমাত্র ফুটপাথ দখলমুক্ত এবং অবৈধ পার্কিং বন্ধ করে যানজট পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে৷ এক্ষেত্রে বোগোটো এবং কলম্বিয়ার একটি উদাহরণ। তাদের অবস্থা আমাদের দেশের চেয়েও খারাপ ছিল, এখন আর সে অবস্থা নেই৷ আমাদের এখানে সবাই মেগা প্রকল্প নিয়ে ভাবে, কারণ এতে মেগা লাভ আছে৷

দুই।

# সর্বশেষ বরাদ্দ অনুযায়ী পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ১৫০টি স্পান, ৬,১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবচে বড় সেতু। সরকারের পরিকল্পনামাফিক ২০১৮ সালের শেষের দিকে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা। সেতুটি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি। এর কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪।

তিন।
# মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাজমহল নির্মাণ করেন। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে কাজ শুরু হয়ে তা সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তাজমহল নির্মাণের প্রধান স্থপতি ছিলেন তুরস্কের মুহমদ ঈসা আফেন্দি।

# ২০ হাজার শ্রমিক ২২ বছর ধরে এই স্থাপনা নির্মাণ করেন। নির্মাণ খরচ নির্বাহের জন্য সারা দেশের প্রায় সকল গণমুখী কাজ বন্ধ রাখা হয় এবং রাজকোষের টাকা এই বাবদে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যে কারণে দেশের মানুষ নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়। দেশে প্রচণ্ড অভাব এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনাহারে মানুষ মারা যেতে থাকে। বিদেশি এসব শাসকদের সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না। তারা ছিল ভোগবিলাসী এবং অত্যাচারী।

# ব্রিটিশ শাসনের নেতিবাচক দিক নিয়ে যেভাবে ইতিহাস রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং সাধারণের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, মোঘল সম্রাটদের অত্যাচার, নির্যাতন, নারীলিপ্সুতা ও ভোগবিলাসের কাহিনী সেভাবে তুলে ধরা হয়নি বলে আমরা তা জানি না। কিন্তু এরাও ছিল বিদেশি এবং ব্রিটিশদের থেকে অনেক বেশি খারাপ। এরাও শোষণ করতে এসেছিল, ভালবেসে আসেনি, সে প্রশ্নও অবান্তর। ব্রিটিশরা বরং অনেককিছু দিয়ে গেছে, আর এরা খালি খেয়েই গেছে।

চার।

আমরা যে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যয় বহনের পরে এই ব্যয় বহন করার সামর্থ্য কি সত্যিকারেই আমাদের আছে? সারাদেশের রাস্তাঘাটের যা অবস্থা তাতে মানুষ নাকাল হয়ে যাচ্ছে। না আছে যথার্থ নির্মাণ, না আছে ব্যবস্থাপনা।

মানুষের চরম দুর্ভোগের পাশাপাশি এ জন্য যে লোকসানি গুণতে হচ্ছে তা দিয়ে প্রতিবছর তিনটে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়। ফলে সময় ও সামর্থ্যকে বিবেচনায় নিলে আসলেই কি আমরা নিজ খরচায় পদ্মা সেতু নির্মাণের অবস্থানে আছি। সম্রাট শাহজাহানের মতো কোন জিদ কি আমাদের গ্রাস করেছে? সে ছিল ভিনদেশি শোষক, তার মতো জিদ কি আমাদের মানায়?

দেশ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও শক্তিমান সরকারী চাকুরেদের দৌরাত্ম্যে জীবন ওষ্ঠাগত। কোথাও কোনও জবাবদিহিতা নাই। এই দেশের সরকারি সিস্টেমকে উৎকোচ না দিয়ে একটা কাজও হয় না। এগুলির উন্নয়ন করলে তা কি উন্নয়ন কাজের মধ্যে পড়তো না?

উন্নয়ন যদি করতেই হয় তবে দুর্নীতি উচ্ছেদ করে নৈতিক উন্নয়ন করাটাই বেশি জরুরি। মনে যদি শান্তি থাকে তবে ছয় মিনিটের পদ্মা সেতু মানুষ ছয় ঘণ্টায় মনের সুখে পার হতে পারে। আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে নাকি কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে সেটিও গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয় আছে। দুর্নীতি টিকিয়ে রেখে উন্নয়ন আসলে তাসের ঘর, বিষদাঁত না ভেঙ্গে কালসাপ পোষা।

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 15/07/2018
সর্বমোট 3458 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন