ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ধারাবাহিক উপন্যাস: ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি (পর্ব—১৩)



















ধারাবাহিক উপন্যাস:

ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি
(পর্ব—১৩)

সাইয়িদ রফিকুল হক
 
ইয়াসিন আজও যথাসময়ে অফিসে এসে ঢুকলো। এটি তার কাছে এখন একটা নিয়মে ও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে কোম্পানির প্রতি সবসময় বিশ্বস্ত। আর সে অফিস-ফাঁকি দেওয়ার কথা কখনও ভাবতে পারে না।
অফিসে ঢুকে তার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। আর সে দেখলো, এখনও অনেকে অফিসে এসে পৌঁছায়নি। কিন্তু এখন নয়টার বেশি বাজে! ব্যাপারটা তার কাছে ভালো মনে হলো না। সে জানে, অফিসের কিছু লোক নিয়মিত অফিস ফাঁকি দিচ্ছে। এরা হয় ট্রাফিক-জ্যাম, আর নয়তো রাস্তায় নানারকম প্রতিবন্ধকতাসৃষ্টি কিংবা গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিলো না বলে বিভিন্নরকম কৃত্রিমসংকটসৃষ্টি করে এই অপকর্মটি করছে। তার মনে হলো: এরা দেশের শত্রু।
ইয়াসিন এদের কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারলো না।
কিন্তু তার পরিচিত জামানসাহেব ঠিক সময়ে অফিসে এসেছেন দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। সে নিজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জামানসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
আর তাকে দেখামাত্র জামানসাহেব সসম্মানে উঠে দাঁড়ালেন। ইয়াসিন একটু দূর থেকেই তাকে বাধা দিয়ে বললো, “থাক-থাক ভাই। আপনাকে আর উঠে দাঁড়াতে হবে না। আপনি বসুন-বসুন।”
কিন্তু জামানসাহেব তাকে দেখে সটান দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি মানুষকে সম্মান করতে ভালোবাসেন। আর অফিসিয়াল নিয়মকানুনের প্রতি তার খুবই শ্রদ্ধা। তাই, তিনি বসলেন না।
ইয়াসিন তবুও তাকে একটু দূর থেকে হাততুলে বসতে বললো। তারপর সে তার কাছে গিয়ে বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো, “কেমন আছেন, জামানভাই? গতকাল খুব ব্যস্ততার দরুন আপনার সঙ্গে দেখাই করতে পারিনি। আজ তাই সকালেই কাজটা সেরে নিলাম।”
কথা শেষ করে ইয়াসিন একটু হাসলো।
 
ইয়াসিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসাতেই জামানসাহেব খুব খুশি হয়েছেন। আর তিনি সবিনয়ে ও কাঁচুমাচুভঙ্গিতে বললেন, “জানি স্যার, আপনার ব্যস্ততা এখন বেড়ে গেছে। আর গতকাল আপনার সাহস ও বাহাদুরী দেখে আমার মনটা ভরে গেছে।”
ইয়াসিন এবার আরেকটু বেশি হেসে বললো, “দোয়া করবেন ভাই। আপনি আমার মুরুব্বীমানুষ।  আপনার দোয়া আমার জন্য পাথেয়।”
 
আরও কয়েকজন কর্মচারী পাশাপাশি টেবিলে কাজ করছে। তারাও ইয়াসিনের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তবে দুই-একজন তাকে খুব-একটা পাত্তা দিলো না। তাদের ভাবখানা এমন যে, তারা ইয়াসিনের সমপর্যায়ের কিংবা তার চেয়েও বড়। ব্যাপারটা ইয়াসিন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো।
তবে এদের পাশে বসা কম্পিউটার-সেকশনের একটি মেয়ে ইয়াসিনকে দেখে জামানসাহেবের মতো সসম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “স্যার, গতকাল আপনার পারফরম্যান্স দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনার মতো মানুষ থাকলে কেউ এই অফিসের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
ইয়াসিন তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “খুশি হলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।”
তারপর সে মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার নামটা মনে হয় আমি ভুলে গেছি!”
সঙ্গে-সঙ্গে সেই মহিলা-অফিসসহকারী বললো, “স্যার, আমার নাম মাহমুদা সুলতানা। আর ডাকনাম সাথী। গ্রামের বাড়ি আপনাদের ওদিকেই।”
ইয়াসিন হেসে বললো, “আচ্ছা, এবার আপনার নামটা মনে থাকবে।”
 
ইয়াসিন আরও কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে কুশলবিনিময় করে তারপর সাধারণ কর্মচারীদের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
সে এই অফিসের একজন সহকারী-ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে তার জন্য অনেক আগে থেকে ছোটখাটো একটা কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে। সে রুমে থাকলে এখানে মাঝে-মাঝে একজন অফিসসহায়কও এসে ঢুঁ মেরে যায়। কিন্তু আজ সে তার অফিসকক্ষে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে বড়সাহেবের খাসপিয়ন দবির পর্যন্ত এসে তার সঙ্গে একবার দেখা করেছে। আর অফিসের এজমালি-পিয়ন কাশেম এ-পর্যন্ত তার কাছে দু’বার এসেছে। তার এখনও কিছু লাগবে না বলে সে তাকে দু’বারই ফিরিয়ে দিয়েছে।
 
ইয়াসিন নিজের কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে লাগলো। আজ আবার তাকে বাইরে যেতে হতে পারে। তার জন্য সে আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। সে কোনো কাজ জমিয়ে রাখার পক্ষপাতি নয়। হাতে কাজ জমলে তার অস্থির লাগে। আর কখন এটি শেষ হবে—এজন্য তার ভিতরে একধরনের প্রবল অস্থিরতা ও দায়িত্ববোধ কাজ করে। সে সকলের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলে না। লোকের সাধারণ স্টাইল কিংবা রুচিবোধ তাকে কখনও আকর্ষণ করে না। ইতোমধ্যে সে এই অফিসে তার নিজস্ব একটা স্টাইল চালু করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য নিচের দিকের লোকজন তাকে বেশ সমীহ করে থাকে। তবে সবাই যে তাকে ভালোবাসে তা নয়। দুনিয়ায় সকলের ভালোবাসা পাওয়াটা বিরাট একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর ইয়াসিন ওতদূর আশাও করে না। সে অল্পে সন্তুষ্ট। তার বাবা তাকে এটি শিখিয়েছেন। এজন্য ইয়াসিন নিজের বর্তমান অবস্থার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট।
 
ইয়াসিন দেখলো, এখন সকাল সাড়ে নয়টার অনেক বেশি বেজে গেছে—তবুও জেনারেল ম্যানেজার সাহেব এখনও অফিসে আসেনি। তার মনে বিরাট একটা খটকা লাগে। আর সে ভাবে: লোকটা এভাবে নিয়মিত অফিস-ফাঁকি দিচ্ছে কার স্বার্থে? সে তো বড়সাহেবের সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ইয়াসিন এটা মানতে পারলো না। আর এধরনের লোকজনকে সে কখনও পছন্দও করে না। সে জানে: এগুলো নিষ্কর্মা আর দেশের শত্রু।
 
 
ইয়াসিন আজ থেকেই অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রমোশনের লিস্ট তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে বসে থাকার মতো ছেলে নয়। সে এখন বুঝে গেছে, এই অফিসের স্বার্থে অফিসের   কিছুসংখ্যক যোগ্যলোকের দ্রুত প্রমোশন হওয়া প্রয়োজন। এখানে, কালবিলম্ব করার কোনো সুযোগ নাই। সে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সাধারণ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রমোশনের লিস্ট তৈরি করছে।
 
অফিসের অনেক কথা ভাবতে-ভাবতে ইয়াসিন নিজের কাজগুলো প্রায় শেষ করে ফেললো। এমন সময় অফিসের সেই এজমালি-পিয়ন কাশেম তার কাছে এসে বললো, “স্যার, জিএম-স্যার আপনারে এখনই একবার ডাকতিছেন।”
ইয়াসিন ওর কথা শুনে অবাক হয়ে বললো, “আমাকে তিনি ডাকতে বলেছেন নাকি সালাম জানিয়েছেন?”
কাশেম এবার কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “স্যার, উনি তো আপনাকে ডাকতেই বলেছেন। আর উনি যেভাবে বলেছেন, আমি সেভাবেই কথাটা আপনাকে বলেছি। আর তিনি আমাকে ডেকে বললেন, যাও, তাকে বলবে—আমি তাকে ডেকেছি।”
সব শুনে ইয়াসিন বললো, “আচ্ছা, তুমি এখন যাও। আর প্রয়োজন মনে করলে আমি পরে যাবো।”
কাশেম কিছু বুঝতে না পেরে নীরবে চলে গেল।
 
ইয়াসিন এবার ঠাণ্ডামাথায় ভাবতে লাগলো: জেনারেল ম্যানেজার নিশ্চয়ই তার উপরে খুব ক্ষেপে আছে। তাই, সে অফিসিয়াল ভাষাজ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু জেনারেল ম্যানেজার তার উপরে হঠাৎ করে এমন ক্ষেপেছে কেন? এব্যাপারে সঠিক উত্তরটা পেতে তার বেশি সময় লাগলো না। সে বুঝতে পারলো: গতকাল জুতার ফ্যাক্টরিতে অভিযানের পর সে কারও-কারও চক্ষুশূল হয়েছে। তবে তারা তো হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র। আর এরা সবাই জিএম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোই হবে।
 
ইয়াসিন নিজের কক্ষে আপনমনে অফিসের প্রমোশনের লিস্ট তৈরি করতে-করতে ভাবছিলো: হয়তো তার এই লিস্টটা দেখে অনেকের মাথাখারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু এতে কোম্পানির মাথাটা বেঁচে যাবে। আর এই কাজটি তাকে করতেই হবে। কোম্পানির স্বার্থেই তাকে এমন একটি সাহসীপদক্ষেপ নিতেই হবে। ভিতরে-ভিতরে ইয়াসিন নিজেকে সাহসী করে তুলতে থাকে। আর সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে: সবার প্রমোশন হবে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে। এখানে, দলবাজির কোনো সুযোগ থাকবে না।
 
ইয়াসিন খুব সতর্কতা আর সততার সঙ্গে প্রমোশনের লিস্ট তৈরি করছিলো। এমন সময় জিএম সিদ্দিকুল আলমের খাসপিয়ন মোস্তফা সরাসরি ইয়াসিনের রুমে ঢুকে তার সামনে দাঁড়িয়ে খুব ভারিক্কিচালে বলে উঠলো, “স্যার, জিএম-স্যার আপনারে এখনই একবার ডাকতিছেন! আর আমার সঙ্গেই আপনারে যাইতে কইছেন!”
কথাগুলো শুনে ইয়াসিন রাগান্বিত না হয়ে মোস্তফার দিকে সহজভঙ্গিতে তাকালো। এতে মোস্তফা একটু ভয় পেয়ে গেল। আর সে নিজে বাঁচার জন্য বললো, “স্যার, জিএম-স্যারের হুকুমে আমি চলি। আমারে ভুল বুইঝেন না। তিনি যেভাবে বলতে বলেছেন, আমি সেভাবেই বলেছি। আমার কোনো দোষ ধইরেন না, স্যার।”
ইয়াসিন ওর থতমতভাব দেখে ও-কে কিছু বললো না। শুধু ওর দিকে একবার চেয়ে খুব শান্তভাবে বললো, “তোমার জিএম-সাহেবকে গিয়ে বলো—আমি তাকে সালাম জানিয়েছি। আর তাকে এখনই আমার এখানে আসতে বলো।”
কথাটা শোনামাত্র মোস্তফা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সে যেন কিছুটা চলৎশক্তি হারিয়েছে।
তার হাবভাব দেখে, ইয়াসিন বললো, “কী হলো! যাও। তাকে গিয়ে বলো আমি তাকে এখন সালাম জানিয়েছি।”
মিনিটখানেক পরে মোস্তফা যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, “জ্বী-আচ্ছা, স্যার।”
মোস্তফা চলে যেতেই ইয়াসিন আপনমনে হাসলো। আর পরক্ষণে সে নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। আর ভাবতে লাগলো—জিএম-সাব এলে তাকে কী-কী বলতে হবে। এই লোকগুলোকে শায়েস্তা না করলে কোম্পানি অচিরেই লাটে উঠবে।
 
মিনিট দশেক কেটে যাওয়ার পর ইয়াসিন বুঝতে পারলো জিএম-সাব আসবে না। সে আগের মতো আবার নিজের কাজ করতে লাগলো।
 
কিছুক্ষণ পরে তার রুমে এসে ঢুকলো দবির। সে হাসি-হাসি মুখে বললো, “স্যার, বড়সাহেব আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।” কথাটা বলেই সে দ্রুত কক্ষত্যাগ করলো।
ইয়াসিন দ্রুত নিজের ব্যক্তিগত-কম্পিউটার অফ করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
 
সে সালাম দিয়ে বড়সাহেবের রুমের সামনে দাঁড়াতেই বড়সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আসুন, আসুন। আপনাকে অনুমতি দেওয়াই আছে। আপনি সোজা ঢুকে পড়বেন।”
 
ইয়াসিন রুমে ঢুকে দেখলো বড়সাহেবের পাশেই হাসি-হাসি মুখে বসে আছে তানজিলা। আজকে তাকে আরও সুন্দর লাগছে। আর আজও সে সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। শাড়িতে তাকে খুব মানায়। আর পৃথিবীর সব শাড়ি যেন তার জন্যই তৈরি হয়েছে!
 
ইয়াসিন স্বাভাবিকভঙ্গিতে বড়সাহেবের সামনে চুপচাপ বসে রইলো।
বড়সাহেব একটা ফাইল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। ইয়াসিন বুঝতে পারলো: এটি পড়া শেষ না করে তিনি উঠবেন না। তাই, সে বড়সাহেবকে কিছু বলার চেষ্টা করলো না।
এরই একফাঁকে ইয়াসিন কৌশলে তানজিলার সঙ্গে ইশারায় একবার শুভেচ্ছাবিনিময় করে নিলো। তবে সে অফিসিয়াল শালীনতার বাইরে কোনোকিছুই করলো না।
বড়সাহেবের পড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে ইয়াসিন মুখে কোনো কথা বলছে না।
 
কয়েক মিনিট পরে বড়সাহেব ফাইলটা বন্ধ করে মুখ তুললেন। আর ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “আজ আমাদের অফিসে আসতে লেট হয়ে গেল। কিন্তু বাকীদের খবর কী?”
ইয়াসিন বললো, “স্যার, জিএম-সাব প্রায় ঘণ্টাখানেক লেট করে আজ অফিসে এসেছেন। আর উনার প্রধান সাগরেদ এবং এই অফিসের অর্থবিষয়ক ম্যানেজার ফয়জুল্লাহ এখনও আসেননি। তিনি প্রায় প্রতিদিন লেট করে অফিসে আসেন। আর জিএম-সাব দেরি করে এসে তার পিয়ন পাঠিয়ে আমাকে ইনসাল্ট করে ডেকেছিলেন। আমি তার ডাকে সাড়া দেইনি, স্যার।”
তারপর সে পুরো ঘটনাটা বড়সাহেবকে খুলে বললো।
 
বড়সাহেব সব শুনে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “খুব ভালো করেছেন। এইসব লোকদের একটু টাইট দেওয়া প্রয়োজন। আপনি ঠিক কাজটিই করেছেন। তাছাড়া, আপনি তো এখন তারচেয়ে বড়পদে। হোক না তা গুপ্ত। তবুও তো আপনি এখন সিনিয়র। আর আপনি তার অধীনস্থ হলেই বা কী? আপনাকে সে তো সঠিকভাবে ডাকেনি। আপনার যথাযথপদক্ষেপের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
তানজিলা বললো, “বাবা, জিএম-সাব কি মাতাল নাকি?”
বড়সাহেব হেসে বললেন, “এরা মাতাল নয়, মামণি। এরা বড় স্বার্থপর। আর বড় ধূর্তপ্রকৃতির লোক। আমাদের ইয়াসিনসাহেব আশা করি তাকে চিনতে পেরেছেন। আমি ইয়াসিনের হাতেই তাকে বধ করবো। আর-একটু সবুর কর, মামণি।”
বড়সাহেব তারপর কথার মোড় ঘুরিয়ে ইয়াসিনের দিকে চেয়ে বললেন, “আমরা বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি। তারই একটা ফাইল আমি এতোক্ষণ পড়ছিলাম।”
একটু পরে তিনি ফাইলটা ইয়াসিনের হাতে তুলে দিতে-দিতে বললেন, “আপনি এটা খুব ভালোভাবে কয়েকবার পড়বেন। আর খুব মনোযোগ দিয়ে এটা পড়বেন। তবে এখনই এটা পড়ার দরকার নাই। অফিস-টাইমের বাইরে কিংবা একান্ত-নিরিবিলি সময়ে এটা পড়বেন। এখন এটা যত্ন করে আপনার কাছেই রাখুন।”
ইয়াসিন ‘জ্বী-স্যার’ বলে সেটি নিজের হাতে তুলে নিলো। তারপর সে তার ব্যক্তিগত-ব্যাগে সেটি ভরে রাখলো।
অফিসিয়াল-কাগজপত্র সে সবসময় খুব সাবধানে রাখে।
 
দবির সবার জন্য গরম কফি নিয়ে এলো। ইয়াসিন কফিতে চুমুক দিয়েই বুঝলো, দবির আসলেই একটি কাজের ছেলে। আর সে চা-কফি বানাতে যথেষ্ট পারদর্শী। তাছাড়াও, ছেলেটি যথেষ্ট ভদ্র আর বিনয়ী। আর বড়সাহেবের খাসপিয়ন হিসাবে তাকেই মানায়।
 
বড়সাহেব কফি পান করতে-করতে ইয়াসিনের দিকে চেয়ে বললেন, “আজকে আপনার কাজ কতটুকু পেন্ডিং আছে?”
ইয়াসিন বললো, “স্যার, আমাদের এই অফিসে আমার কোনো কাজ পেন্ডিং নাই। আমি সকালে এসে ঘণ্টাখানেক কাজ করেছি। আর আপনি বর্তমানে আমাকে যে প্রমোশন-লিস্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়েছেন,   তা আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছি। আশা করি, এই কাজের বাকীটা আজ বিকাল পাঁচটার আগেই শেষ হবে।”
বড়সাহেব একথা শুনে খুশি মনে বললেন, “তাহলে তো আপনাকে এ-অফিসে বসিয়ে রেখে কোনো লাভ নাই। আপনি বরঞ্চ আজ আবার গাজীপুরে আমাদের জুতা-ফ্যাক্টরিটা একবার ঘুরে আসুন। আশা করি, আপনার প্রচেষ্টায় আমরা আবার এটি আগের মতো লাভজনক একটি কারখানায় পরিণত করতে পারবো।”
ইয়াসিন বললো, “স্যার, এব্যাপারে আমার আন্তরিকতার কখনও-কোনো ঘাটতি হবে না। আর আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় এটি অল্পদিনের মধ্যে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।”
বড়সাহেব হেসে বললেন, “আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। আর আপনার চেষ্টা সফল হোক। তাহলে,   আপনি এবার গাজীপুরের দিকে রওনা হয়ে যান। আর যাওয়ার সময় আপনি আজও আমার এই মামণির গাড়িটাই নিয়ে যান।”
ইয়াসিন সঙ্গে-সঙ্গে কফিটুকু শেষ করে ‘জ্বী-স্যার’ বলে উঠে পড়লো।
এমন সময় তানজিলা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা, আজ আমি উনার সঙ্গে গাজীপুরে   গিয়ে ফ্যাক্টরিটা একটু দেখে আসি?”
বড়সাহেব বললেন, “তুমি যাবে? কিন্তু, এতে যদি ইয়াসিনের আবার কাজের ব্যাঘাত হয়!”
ইয়াসিন প্রায় দরজার কাছে চলে এসেছিলো। সে এবার একটুখানি ঘুরে সেখানেই দাঁড়িয়ে বড়সাহেবের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো, “স্যার, এতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। বরং এতোটা পথ জার্নি করলে হয়তো উনার কষ্ট হতে পারে।”
তানজিলা বললো, “জার্নিতে আমার কোনো কষ্ট হবে না। তাছাড়া, ব্যবসাটা তো আমাকে দেখেশুনে, বুঝেশুনে নিতে হবে। শুধু আপনার হাতে ছেড়ে দিলেই হবে!”
শেষের কথাটা বলে সে হাসতে লাগলো। ইয়াসিনও হাসলো। আর একথা শুনে বড়সাহেবও হাসলেন। আর হয়তো ভাবলেন: মেয়েটা এবার কাজমুখী হচ্ছে।
তানজিলার গাজীপুরে যাওয়ার ব্যাপারে বড়সাহেব আর আপত্তি করলেন না। তিনি হাসিমুখে এতে সদয়-সম্মতিদান করলেন।
ইয়াসিন এবার তানজিলার উদ্দেশ্যে বললো, “ম্যাডাম, আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। আমি কিছু কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে চটজলদি আসছি।”
 
ইয়াসিন বেরিয়ে যেতেই তানজিলা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বড়সাহেবের পাশে বসে খুব আস্তে-আস্তে বলতে লাগলো, “বাবা, আমি এখন ব্যবসাটা ধরে রাখতে বিরাট একটা ভরসা পাচ্ছি। এইরকম একটা মানুষ সত্তরটা লোকের চেয়েও যোগ্য।”
তানজিলার মুখে হঠাৎ একথা শুনে বড়সাহেব হাসলেন। তারপর তিনি মেয়ের চিবুকে হাত রেখে বললেন, “সত্তরটা নয় মা—বলো একশটা। সে আমাদের একশটা লোকের চেয়ে বেশি দায়িত্বপালন করতে পারবে। এইজন্য আমি তাকে ধীরে ধীরে উপরে টেনে তুলছি। আর খুব শীঘ্র তাকে এই   কোম্পানির সবচেয়ে বিশ্বস্ত-কর্মকর্তায় পরিণত করবো। এই অফিসের শয়তানগুলোকে জব্দ করার জন্য সে একাই একশ’।”
তানজিলা হেসে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দবির তাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে তার পিছনে হাঁটতে লাগলো।
 
ইয়াসিন গাড়ির কাছে এসে দেখলো, তানজিলা গাড়িতে বসে রয়েছে। সে আর কালবিলম্ব না করে গাড়ির সামনের সিটে ওঠার জন্য কাছে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ড্রাইভার তাকে বাধা দিয়ে বললো, “স্যার, আপনাকে পিছনে বসতে হবে। ম্যাডাম তা-ই বলেছেন।”
একথা শুনে ইয়াসিন ডানপাশে ঘুরে তাকাতেই তানজিলা হাত নেড়ে তাকে পিছনের সিটে বসতে ডাকলো।
সে তানজিলার পাশে পিছনের সিটেই বসলো। আর সে দেখলো, আজকে নতুন একজন ড্রাইভার। সে কিছু বলার আগেই তানজিলা বললো, “ওর নাম ইয়াকুব। আমাদের সবচেয়ে বিশ্বাসী-ড্রাইভার সে। বিশেষ করে সে আমার গাড়িই চালায় বেশি। আবার মাঝে-মাঝে বাবারটাও চালায়। তবে বাবা এখন মমিনুলকে নিজের গাড়িতে বহাল করবেন।”
 
ইয়াসিন বুঝলো, তানজিলা অনেক বুদ্ধিমতী। সে কিছু না বলতেই তার মনোভাব সে বুঝে ফেলেছে। বুদ্ধিমতী মেয়েদের তার খুব ভালো লাগে। এদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। আর সাধারণ মেয়েগুলো শুধু সেক্স, টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি আর শাড়ি-গহনার মধ্যেই ডুবে থাকতে চায়। ইয়াসিনের, এদের কক্ষনো ভালো লাগে না।
 
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
ইয়াসিন খুব ভদ্রভাবে তানজিলার পাশে বসে আছে।
এমন সময় তানজিলা একটু হেসে ইয়াসিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি আমাকে ফ্যাক্টরিতে না নেওয়ার মতলব করছিলেন কেন?”
কথাটা শুনে ইয়াসিন হেসে ফেললো। আর সে যেন কিছুই জানে না—এমন একটা ভান করে বললো, “কই নাতো! সেরকম তো কিছু বলিনি!”
তারপর সে একটু থেমে বলতে লাগলো, “আপনাকে এতোদূরের পথে নিয়ে গিয়ে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছিলো না তাই...। আসলে, আপনি আসাতে আমি খুশিই হয়েছি। কিন্তু স্যারের সামনে তো আর সরাসরি আপনার কথায় সমর্থন দিতে পারি না। আগে দেখলাম, স্যার কী বলেন। আবারও বলছি:  আপনি আসাতে আসলে আমি খুশিই হয়েছি।”
তানজিলা আগের মতো হেসে বললো, “সত্যি বলেছেন?”
ইয়াসিন বললো, “হ্যাঁ, সত্যি। আমি মিথ্যা বলি না।”
ইয়াসিনের কথা শুনে তানজিলা খুব সুন্দর করে হেসে বললো, “আপনি খুব ভালো ছেলে।”
তানজিলার কথা শুনে ইয়াসিন হাসতে লাগলো।
 
একটা সময় ইয়াসিনের মনে হলো: ড্রাইভার তাদের কথাবার্তা সব শুনে ফেলতে পারে। তাই, সে হঠাৎ বললো, “ইয়াকুব, আমরা এতোদূরের পথে যাচ্ছি একটা গানটান বাজাও।”
ইয়াকুব একথা শুনে হেসে বললো, “স্যার, কী গান দেবো?”
ইয়াসিন কী যেনো একটু চিন্তা করে বললো, “একটু রোম্যান্টিক গান দাও তো!”
ইয়াকুব আবার বললো, “তবুও স্যার আপনি বলে দিলে ভালো হয়।”
ইয়াসিন এবার তানজিলার দিকে চেয়ে বললো, “আপনি বলেন তো!”
তানজিলা হাসে আর বলে, “আপনিই একটা বলে দিন। আমি শুনবো। আর রোম্যান্টিক গান আমার ভালো লাগে।”
ইয়াসিন এবার কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা—একটুকু ছোঁওয়া লাগে..., আগে বাজাও তো। তারপর বাকীগুলো বলছি।”
 
ইয়াকুব গানটা চালু করে দিলো। গাড়িটা যেন মুহূর্তের মধ্যে গানের সুমধুরসুরে আর সুঘ্রাণে ভরে গেল! ইয়াসিন তন্ময় হয়ে গানটা শুনছিলো। আর তানজিলাও।
 
ওদের বুকের মধ্যেও বাজছে কিনা—‘একটুকু ছোঁওয়া লাগে’...!
 
 
(চলবে)
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
 
 

ছবি
সেকশনঃ সাহিত্য
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 26/11/2017
সর্বমোট 2996 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন