ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

কাবিনের গোলাপ

অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ের পিড়িতে আমাকে বসতেই হলো। আমি বলিনি আমি বিয়ে করব না তবে কেন জানি অপূর্বের কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। প্রথম দেখার পর থেকেই ওর কথা ভাবলেই কেমন জানি অজানা অনুভূতি কাজ করে যেখানে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। বড়জোড় বন্দুত্ব হতে পারে। এর বাইরে... impossible. অপূর্বের মধ্যে আমার বাবা মা যে কী এমন হাতি ঘোড়া দেখেছিলেন তা উনারাই জানেন। ও হ্যাঁ, অপূর্ব আমার স্বামী যাকে ভালো না বেসেও আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিলো । টিনের চালের ফুটো দিয়ে যেমন করে আলোক রশ্মি উঁকি দেয় অন্ধকার ঘরে তেমনি করেই বন্ধনের আগেই খানিকটা মুক্তির সুযোগ উঁকি দিয়েছিল। ওই আলোক রশ্মির মতোই সে সুযোগটাও ছিল অতি ক্ষীণ তাকে কাজে লাগিয়ে প্রদীপ জালানো সম্ভব হয়নি আমার। আমি ছিলাম নির্বাক দর্শক। অবিভক্ত ভারতের একজন গ্রাম্য নাগরিকের মতো আমি শুধু মনে মনে চেয়েছি সীমানার রেখাটুকু আমার গাঁয়ের ওপর দিয়ে যেন না যায়। কিন্তু আমার চাওয়া পাওয়ার খোঁজ রাখে কে?
ধুমধাম বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ পিন পতন নিরবতা। এর কান ওর মুখ ঘুরে কারণটাও আমার কাছে চলে আসে পাখির ডানায় ভর করে। অপূর্ব নাকি কাবিনে কোনো আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি না। যদিও ওই প্রতিশ্রুতিটুকু নারীর ধর্মীয় অধিকার বলেই গণ্য হয় এবং ওর পরিধি এক পৃষ্টার কাগজের মধ্যেই বন্দি। আর আজ অব্দি কোনো স্বামী সাংসারিক জীবনে ওই ঋণ পরিশোধ করেছে বলে কোনো খবর কেউ খবরের কাগজে পড়েনি কিংবা টিভির স্ক্রলে দেখেনি। শুধু মাত্র সামাজিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন মানার জন্যই টাকার কথা উল্লেখ করা। তবুও সে তা মানতে রাজি নয়। বরং তার যুক্তি যা মানা হয় না বা মানব না তার প্রতিশ্রুতি কেনো দেব? তাছাড়া যেখানে অর্থকড়ি জড়িত সেখানে একপক্ষ ক্রেতা অপর পক্ষ বিক্রেতার চেয়ে বেশি মর্যাদা পাওয়ার আশা করতে পারে না। বিয়ে করতে এসেছি পন্য কিনতে বা বিক্রি করতে নয়।
আমার বাবার চেয়ে ওর বাবাই বেশি ক্ষেপে গেলেন যখন শুনলেন তার এতদিনের বাধ্য সন্তান আজ তার সামনেই বলছে, কাবিন হিসেবে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতির বাইরে সে অন্য কিছু দিতে পারবে না এবং দিবে না। কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন তো সম্ভবই না। যদি প্রতিশ্রুতিদিতেই হয় তবে অর্থের পরিবর্তে ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রতিদিন তার বউকে একটি করে লাল গোলাপ দেবে। যদিও গোলাপ তার নিজেরও খুব একটা পছন্দের ফুল না তবে আজকাল সারা বছরই পাওয়া যায় বিধায় গোলাপের নামই সে প্রস্তাব করেছে অবশ্য বউয়ের পছন্দ অনুযায়ী ঋতু ভেদে ফুল পরিবর্তন হতে পারে। অপূর্বের কথা শুনে সবাই সেদিন আকাশ থেকে পড়েছিলো। আরে বাবা, হাসবেন্ড ওয়াইফকে ভালোবাসবে এইটাই তো স্বাভাবিক। এ আর ঘটা করে বলার কী আছে? তবে মেয়ের সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবেই তো কাবিন। সেটা অঙ্গিকার করবে কি করে?
তার সোজা সাপটা জবাব, মেয়ে নিজেও শিক্ষিত। সামাজিক নিরাপত্তা সে নিজেই নিশ্চিত করবে। আর যদি বিশ্বাস আর ভালোবাসা না থাকে তাহলে এক কোটিতেও কী সে সম্পর্ক টিকবে?
ওর কথায় যুক্তি ছিলো অবশ্যই। ওর বাবা খানিকটা মুখ ভার করে বসে রইলেন। আমার বাবা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। বিয়ের আগে এসব নিয়ে কেউ কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেনি। কারণ বলে কয়ে লেনদেনের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তবে অপূর্বের এসব পাগলের প্রলাপে একজন অনেক খুশি হয়েছিলেন। সে আমার মা। কোনো এক বিশেষ কারণে ভদ্রমহিলা ওকে খুব পছন্দ করেন। তিনি তো খুশিতে ডগমগ হয়ে আমার সামনেই বলতে লাগলেন, মেয়ে আমার খুবই ভাগ্যবতী। তা না হলে এমন বর পায়?
আমার বন্ধু, বান্ধবীরা যারা পুরাতনকে ভেঙ্গে নতুন কিছু গড়ার স্বপ্ন দেখে ওরা তো রিতিমত বিপ্লব খুঁজে পেয়েছিলো অপূর্বের মাঝে। মায়ের আহ্লাদিপনার কাছে আর আমার বন্ধুদের সাপোর্টে সবাই কেমন চুপসে গিয়েছিলো। বিয়েটা ওর মনের মতো করেই হলো। পুরাতনেরা অপূর্বকে বেহায়া এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন বলতে বলতে বাড়ি ফিরলেন। আর নতুনেরা ওর নামে জয়ধ্বনী দিল। কিন্তু এদের মাঝে কেউই আমার মনের খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছাটাও পোষণ করেনি। ওর জয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার চাওয়াগুলো বিলীন হয়ে গেছে যেমন করে চাঁদের আলোতেও অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ছোটছোট কালো পিপড়া।
অপূর্ব ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রীধারী। আমি বাংলায়। ব্যাপারটা উল্টো হলেই বোধহয় ভালো হতো। ওকে যেদিন থেকে জানি সেদিন থেকেই দেখেছি বাংলার প্রতি ওর অসম্ভব মায় আর ভালোবাসা। সেই সঙ্গে রয়েছে ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ। ও মনে করে বাংলা ভাষাটা যদি ইংরেজির মতো বৈশি^ক ভাষা হতো তবে শেক্সপিয়রকে ভুলে সবাই রবীন্দ্রনাথের স্তুতি গাইত। আকতারুজ্জামান ইলিয়াস হতেন বিশ্বের শ্রেষ্ট ঔপন্যাসিক। আর ওয়াডর্সওর্থের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হতেন জীবন বাবুর নাম।
প্রথম দেখার দিনেই বুঝেছিলাম এর মাথায় সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ আমি আজ অব্দি ক্লাসের বইয়ের বাইরে একটা কবিতাও পড়িনি। আমার বাংলায় ভর্তি হওয়ার ব্যপারটা অনেকটা অনাকাঙ্খিত সন্তান উৎপাদনের মতো। যৌন তৃপ্তি মেটানোর জন্য মিলিত হয়ে ভুলবসত জন্ম দেওয়া সন্তানকে যেমন বাবা মা ফেলতেও পারেন না আবার খুশিতে আঁকড়ে ধরতেও বাধে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে আগলে ধরেন আমার অবস্থা ঠিক তেমনি হয়েছে। ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবো। চান্স পেলাম না। সবার দেখাদেখি অনিচ্ছা সত্বেও বিশ^বিদ্যারয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাংলা পেলাম। না পাড়লাম ছুঁড়ে ফেলতে না পালাম আঁকড়ে ধরতে। ও ছাড়া যে আর অবল্মবনও ছিল না। ভেবেছিলাম বিশ^বিদ্যালয় গণ্ডি পারি দিয়ে একটা ধুলিমাখা জীবন কাটাবো যেখানে থাকবে না রবীন্দ্রনাথের ঘ্যানরঘ্যান, কিংবা জীবনান্দ দাসের পাগলের প্রলাপ কিংবা হাসান আজিজুল হকের দার্শনিক মার্কা কঠিন কঠিন শব্দের সম্মুখ যুদ্ধ। এখন দেখি এরা সবাই এক সঙ্গে বাসা বাঁধছে আমার চিলেকোঠার ঘরে!
যেহেতু ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা কিংবা আকর্ষণ ছিলো না সেহেতু বিবাহ পরবর্তী স্বাভাবিক যৌন কার্যাবলীও আমার কাছে অনৈতিক এবং ধর্ষনের একটা ভিন্ন ধারা বলে মনে হয়েছে। আমি অবশ্য সে কথাটা তাকে বুঝাতে পেরেছিলাম। তখন অবশ্য মনে হয়েছিল পরিবারের মতো উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর চেয়ে ওকে বললেই অতি সহজেই বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া সম্ভব ছিল। সে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলো একা থাকতে। এমনকি গ্রামের বাড়িতে থাকাবস্থায় প্রতিদিন সকালে গোসলের কথাও মনে করিয়ে দিত এবং নিজেও করত আর বাইরের সবার কাছে আমাদের ভাবখানা এমন ছিলো যে এই পৃথিবীতে আমরাই যেন সবচেয়ে খুশি দম্পতি।
বিয়ের চারদিন পরই আমরা চলে আসি ওর কর্মস্থল ঢাকায় যেখানে মানুষগুলোকে আমার ছোট ছোট পিপিলিকা মনে হয়। এরা সারাদিন ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। পাশের বাসার মানুষের সঙ্গেও ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। এরা কথায় কথায় রিক্সাচালককে থাপ্পড় মারে। রাস্তায় ফুল বিক্রেতা মেয়েটিকে ওরা রাস্তার কীটের চেয়ে বেশি সন্মান দেয় না। গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগলেও সরি বলার প্রয়োজনবোধ করে না। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে এরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় না? পুরো শহরটা একটা ইট পাহড়ের জঙ্গল যেখানে নিঃশ্বাসও নিতে পারবেন না আপনি।
দুরুমের ছোট্ট ফ্লাটে ওর ছোট্ট সংসার। সবই আছে শুধু ভালোবাসার দেখা নেই। দুজন দুরুমে ঘুমনোর ব্যবস্থা থাকলেও রাতে আমরা কেউই নিজেদের ঘরের দরজা লক করতাম না। ও করত না যদি আমার কিছু লাগে বা এই রকমই কিছু ভেবে হয়ত, আমি কেন করিনি জানি না। অবশ্য কেন জানি জানতাম বিনা অনুমতিতে ওর প্রবেশের সাহস নেই কিংবা ইচ্ছা নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার খানিকটা দেরিই হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একমাত্র অর্জন, সকাল ভরে ঘুমানোর অভ্যাস। প্রতিদিন চোখের পাতা মেলেই দেখি পাশের টেবিলে একগুচ্ছ গোলাপ কিংবা বেলি বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাঝে মাঝে মন চাইতো ছুঁয়ে দেই, কিন্তু অদৃশ্য এক বাঁধা আষ্টেপুষ্টে ধরে রাখত দু হাত। পা বাড়িয়ে ওর রুমে উঁকি দিয়েই কি সব হাবিজাবি লিখছে ও। পাশে এলোমেলো পড়ে আছে অনেকগুলো বই আর ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে চায়ের মগ।
ও হ্যা, অপূর্ব সাংবাদিক। সেই সঙ্গে লেখক। গল্প, উপন্যাস কীসব লেখে। কিন্তু ওর লেখা কখনো পড়া হয়নি আমার। ইচ্ছাও হয়নি। আজকালকের বাংলা লেখকেরা যে কী ছাইপাশ লেখে সে আমার ঢের জানা আছে। ওর লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়। আমার সেই প্রগতিশীল বন্ধুরাও নাকি ওর লেখায় দারুন ভক্ত। আমার হাসি পায়। হোমর, মিল্টন, লরেঞ্জ, হেমিংওয়ে পড়–য়া ছেলেমেয়েরাও ওর লেখা পড়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ?
আমার অলস সময় কেটে যায় নিজের সঙ্গে কথা বলে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরের দূষিত বাতাস আর মানুষের নির্মমতা দেখে। আমি কথা বলি ছোট্ট বারান্দায় লাগানো অপরাজিতা, নয়নতারা আর ক্যাকটাসের সঙ্গে । ছোট্ট টবে লাগানো তুলসি গাছের নাকের ডগায় গিয়ে বুক ভরে
নিশ্বাস নেই আমি। সারাদিনের সঞ্জীবনি হয়ে কাজ করে এই বাতাসটুকু।
অপুর ঘর থেকে মাঝে মধ্যে কবিতা ভেসে আসে। কখনো বা গিটারের টুনটান শব্দ কিংবা ভায়োলিনের গম্ভীর অথচ একাকিত্বের সুর একা একা ঘুরে বেড়ায় দুরুমের জেলখানায়। বাকি সময়টুকু অপূর্ব বই পড়ে। অথবা লিখে। বিকেলের দিকে অফিসে যায়, ফেরে দশটা এগারটার মধ্যে। ওর খুব একটা বন্ধুবান্ধব আছে বলেও মনে হয় না। আজ অব্দি কাউকে বাসায় আসতে দেখিনি। তবে আজকাল ওর কাছে একটা মেয়ে প্রায়ই আসে। প্রথমদিন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কী যেন নাম। টয়া কিংবা সামথিং লাইক দ্যাট। ক্যাম্পাসের জুনিয়র। চারুকালার শিক্ষার্থী। ওর লেখার ভক্ত মেয়েটা। ওদের আড্ডায় প্রথম প্রথম আমাকেও থাকতে হত। কিন্তু নিরামিষ মার্কা সেই বই, লেখা নিয়ে বকবকানি আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়। তাছাড়া নিরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে আমি অভ্যস্থ নই। অথচ ওদের আড্ডায় কিছু বলার থাকে না আমার। তার চেয়ে বরং আমার ঘরের অপর বাসিন্দা তিনটি টিকটিকির গান শুনতে বেশি ¯^াচ্ছন্দবোধ করি আমি।
ইদানীং ঘুমের ঘোরে আমি স্বপ্ন দেখি। বেশ এলোমেলো বুঁনন স্বপ্নগুলোর। যমুনার পাড়ে সুদর্শন কারো হাত ধরে হাঁটছি আমি। চাঁদনী রাতে বেদে জীবন কাটাচ্ছি আমরা। একটু পরেই আবার দেখি গহনার চাদর গায়ে জড়িয়ে আকাশী রঙের প্রাডোতে চড়ে শহর দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। শহর ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছি বন পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা পথে। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশে বসা সেই সুদর্শনের চেহারা একটুও মনে পড়ে না। তাই ঘুম বিদায় নিলেও খানিকক্ষণ চোখ বুজে থাকি। খুঁজে ফিরি আমার অবচেতন মনের সেই প্রিয় মানুষটিকে। আমার অতীত ঘেটে বের করার চেষ্ট করি সুদর্শন যুবককে। আমার কোনো প্রেমিক ছিল না কখনই। অন্বেষনের প্রাপ্তিতে যোগ হয় হতাশা আর খিটখিটে বদ মেজাজ। হতাশ হয়ে চোখ খুলে তাকালেই দেখি সস্তা গোলাপ আর বেলির মালা ড্যাবড়া ড্যাবড়া চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! মেজাজ সপ্তমে উঠলে সেগুলো নিয়ে ডাস্টবিনেও ফেলে দিয়েছি দুএকবার। অপূর্ব দেখে হেসেছে।
কয়েকদিন ধরে টয়া নামের মেয়েটা বেশ ঘন ঘনই আসছে। যদিও এতে আমার তেমন কিছুই আসে যায় না বরং লাভই হতে পারে। যদি এমন হয় অপূর্ব মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলো। তবে আমার মুক্তির দরজা উন্মুক্ত তো হতেই পারে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ও শুধু লেখকের বই না লেখকেরও প্রেমে মজে আছে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করি। দেখা হলে মিস্টি হেসে কথা বলি। আর দিনভর আমার ¯^প্নের সুদর্শনের খোঁজ করি। অপরাজিতা আর ক্যকটাসের সঙ্গে পরামর্শ করি। কী করে খুঁজে পাব তারে। ওরা আকাশের ঠিকানা দেয়। মেঘের সঙ্গে মিতালির পরামর্শ দেয়। ওরাই নাকি খুঁজে দেবে সেই সুদর্শনকে।
‘আমি পাহাড় বেয়ে উঠছি, এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হলেও আমি এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে মেঘেরা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর খনিকটা গেলেই মেঘের দেখা। সাদা ধবধবে মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে আমার ঠিক সামনেই। ওদের গা স্পর্শ করতে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত আকতে ধরল আমার হাত। পিছন ঘুরেই দেখি অপূর্ব। বিশাল শুন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি, আমরা।’
ঘুম থেকে জেগে উঠেই তাকিয়ে দেখি গতকালকের ফুলগুলো চুপসে গেছে। আজ নতুন ফুল আনা হয়নি কী তবে? এক পা দু পা করে ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি শুন্যতার মাঝে প্রহর গুনছে ওর চেয়ার টেবিল আর পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে চায়ের মগ।
খাবার টেবিলে একটা চিরকুট।
‘বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে।’
“আরে বাবা তুমি বাইরে যাও আর জাহান্নামে যাও আমার কাবিন নামার ফুল কোথায়?”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে আমি ভাবছি,
তবে কি সেই সুদর্শন অপূর্বই ছিল?
কলিং বেলে চিন্তায় ছেদ পড়ল। দরজা খুলে দেখি টয়া দাঁড়িয়ে।
আমাকে দেখেই কেমন চুপসে গেলো মেয়েটা। আজ ওকে বেশ সুন্দর লাগছে যদিও এমনিতেই বেশ সুন্দর সে। তবে আজ যেন লাবন্যটা একটু বেশিই ছিল।
অপূর্ব নেই?
না। ওতো সকালে বেড়িয়েছে।
বেড়িয়ে গেছে শুনেই যেন ওর মুখটা ঝলমল করে উঠল। ঘড়ি দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, আমি আসি তাহলে। বলেই সিড়ি বেয়ে নেমে গেল টয়া।
কেমন যেন অস্বাভাবিকলাগছিল ওকে। তবে কি বেশ খানিকটা আশ্রয় আর প্রশ্রয় মিলেছে ওর?
সন্ধ্যার খানিকটা পড়ে বাসায় ফিরল অপূর্ব। হাত খালি। আজ বেলি কিংবা গোলাপ কেউ আসেনি সঙ্গে।
আমাদের কথা হতো খুব কম। খুব দরকার না হলে হয়ই না। আজও হলো না। কিন্তু নৌকার মাঝি হয়ে ঠিকই এলো ঘুমের ঘোরে।
পরেরদিন সকালেও মিলল না আমার কাবিনের যৌতুক। ঘুম ভাঙ্গল মেয়েলি হাসির শব্দে। টয়া এসেছে। আড্ডা হচ্ছে। আমার মাঝি পাল তুলছে অন্য নৌকায়। আজই প্রথম কেমন জানি হিংসে আর ক্রোধ জাগ্রত হলো।
অপূর্ব পাল্টে যাচ্ছে। এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে সে। অবসরে গিটারে সুর তোলে। ভায়োলিনের গায়ে আচর পড়ে না আর। টয়া আসে। যায়। আমি বরাবরের মতোই নিরব দর্শক। অথচ ¯^প্নরা মুক্তি দেয় না আমায়। তাড়িয়ে বেড়ায় সারা রাত দিন।
শরীরের তাপমাত্রা লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলছে। জ্বরের সময়গুলোতে
একা থাকতে বড্ড ভয় হয় আমার। দেয়ালে হেঁটে বেড়ানো আমার অবসরের সঙ্গী টিকটিকিদেরও এক একটা অসূর মনে হয়। এই বুঝি এগিয়ে এলো আমার দিকে। নখের ডগায় তুলে নিবে আমার তেইশ বছরের কুমরী শরীর। তারপর বিশ্রী মুখের ভিতর দিয়ে চালান করে দেবে। পাশের ঘরে অপু সম্ভবত লিখছে। আলো জ¦লছে। ওকে ডাকার ইচ্ছে হয় কিন্তু সাহস হয় না কেন জানি। কখন জানি খানিকটা ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙ্গে যায় একটা হাতের স্পর্শে। মায়ের হাতের মতো হাতটি ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার কপাল জুড়ে, একেবেকে যাচ্ছে চুল বেয়ে। অপূর্ব?
আমি জেগে জেগে ঘুমাই। একসময় সত্যিই ঘুমাই। চোখ মেলে দেখি হাত নেই, মা নেই, ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে কাবিনের গোলাপ।
অসুস্থ শরীর নিয়ে অলস সময়গুলো কাটে না আজকাল। সেলফ থেকে ওর লেখা ‘চাষাবাদ’ নামের একটা নিয়ে পড়তে থাকি। কয়েক পৃষ্টা পড়ে শুধু মনে হয়েছিল ওকে একবার ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু আমারই হাতে গড়া মাঝের দেয়ালটা আজকাল বেশ পুরু হয়ে গেছে। চাইলেই ভাঙ্গা সম্ভব হয় না। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি ও ফোনে কথা বলছে। নিশ্চয় টয়া। ওর তো এছাড়া আর কেউ নেই।
আজকাল মেয়েটা কম আসে। কিন্তু ঘর জুড়ে ওর অস্তিত্ব টের আমি। মনে হয় অপূর্বকে হারাচ্ছি আমি। কথাটা বেশ হাস্যকর লাগে নিজেরই কাছে। যাকে কখনো গ্রহণই করলাম না তাকে হারানোর কী আছে? কিন্তু আমার চোখের পাতা আমায় প্রতারণা করা শুরু করে দিয়েছে। সেই মাঝি, পাহাড়ের উপর মেঘদের পাতা ফাঁদ থেকে বাঁচানো হাত আমায় প্রতারিত করে। আমার নিজের জ্বালানো আগুন নিভুনিভু আগুনে দাহ করে আমার মন, শরীর।
পরের দিন টয়া এলো। একসময় চলেও গেলো। অপূর্ব কেমন জানি এলোমেলো। কী বুঝে যেন বলেই ফেললাম, Do you love her?
খানিক দ্বিধায় ভর দিয়ে অপূর্ব উত্তর দিলো, কী আসে যায় তাতে?
সত্যিই কী কিছইু আসে যায় না?
আমরা মেয়েরা বোধহয় খানিকটা ঈর্ষা পরায়ণ জাতি। নিজের ধন পায়ে ঠেলে অভ্যস্ত। ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে থাকা সেই ভাঙ্গা কুলাকে কেউ কুড়িয়ে নিয়ে গেলে কষ্টে চোখের জল নাকের জল এক করে বালিশ ভিজাই। অপূর্বকে সত্যিই কখনো চায়নি। আর এখন ও যখন হারিয়ে যাচ্ছে তখনই ওকে পাওয়ার নেশা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। কিন্তু এখন পেলে শুধু ওর শরীরটাই পেতে হবে। মনটা ছিনতাই হয়ে গেছে রাস্তার মোড়ের গলিতে।
আমার স্বপ্নে দেখা সেই সুদর্শনকে হারানোর শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। প্রজাপতি হয়ে ওরা উড়ে বেড়াবে আমারই চোখের সামনে। ওদের সন্তারো লুটোপুটি খাবে উঠোন জুড়ে। আর আমি দীর্ঘশ্বাসের বাতাসে ডুবে যাব। তাছাড়া আর কীই বা করার আছে।
যাকে আমি পাচ্ছি না কিংবা পেয়েও যাকে গ্রহণ করি নাই তাকে অন্যের হাতে তুলে দিলেই হয়ত বেশি মানবিক হতে পারতাম। কিন্তু অতটা মানবিক কোনো কালেই ছিলাম আমি কী?
রাত জেগে আজকাল অপূর্বের লেখা বই পড়তে বেশ ভালোই লাগে। যতই পড়ছি ততই জানছি ওকে। লোকটার লেখক না হয়ে সিরিয়াল কিলার হওয়া উচিত ছিল। খুন করাটাও যে একটা শিল্প সেটা ওর ‘শিরোনামহীন’ না পড়লে বুঝতাম না। আমি শান্তি প্রিয় মানুষ। ভালোবাসি মানুষকে, সকল সৃষ্টিকে। যাকে সৃষ্টি করতে পারব না তাকে ধ্বংস করার অধিকার নেই আমার।
গতকালই ওর নতুন বই বাজারে এসেছে। গল্প গ্রন্থ। তার প্রথম গল্পটা যে টয়াকে নিয়ে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। বইটা শেষ করেই মনে হলো প্রেমিক অপূর্ব জেগে উঠেছে আর লেখকের মৃত্যু হয়েছে। এখন থেকে যা কিছু লিখবে তা শুধু পাঠককে বিরক্তই করবে। তাই লেখকের মৃত্যুটা অতি জরুরি। শুধু অপূর্ব না সব লেখককেই এক সময় অবসর নিতে হয়। অথবা আত্মহনণের পথ বেছে নিতে হয় তা না হলে লেখক তার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার যায়গাটুকু হারাতে থাকেন।
টয়া এসেছে অনেকদিন পর। আজই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। ক্লোরাইডের যৌগটুকু অবশ্য একটু সময় নিয়েই তার প্রভাব বিস্তার করবে। টয়া সবে বেড়িয়েছে। অপূর্ব ওয়াশরুমে। টেবিলের ঠিক কোনায় যৌগটুকুকে রেখে আমি আমার রুমে দরজা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিতেই পারতাম। কিন্তু আমার ঘরে থাকা চলবে না। টুকিটাকি বাজারের দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়। অবসরে কাজটা সেরে নিলে খারাপ হয়।
ফিরে এসে দেখি অপূর্ব কমন বেসিনে চোখ মুখে পানি দিচ্ছে। ধোয়া বিহীন নিরব বিস্ফোরক ভালোই কাজ করেছে বুঝলাম। মৃত লেখক তার দৃষ্টি হারাচ্ছেন।
আমার পিছু পিছু একটা চিঠি এলো। প্রেরক টয়া।
অবাক হলাম চিঠি দেখে। আজকল কেউ চিঠি লেখে ধারণাতেও ছিল না। হলু খামের ভেতর একটাই লাইন
You are really lucky to have a man like Apu

ঘুরে তাকিয়েই দেখি তিনটা গোলাপ আর একগুচ্ছ শিউলি টেবিলের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। ড্যাবড্যাব চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে।

ছবি
সেকশনঃ গল্প
লিখেছেনঃ রাশেদুজ্জামান কানন তারিখঃ 18/11/2017
সর্বমোট 4596 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন