জেলখানায় বিভিন্ন দলের ওয়ার্ড আছে । জামাত শিবিরের ওয়ার্ড , বিএনপির ওয়ার্ড এবং আওয়ামীলীগের ওয়ার্ড । দলের মতাদর্শের লোকরাই সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে থাকতে পারে । দলীয় ওয়ার্ডে থাকলে সুযোগ সুবিধা একটু বেশি ভোগ করা যায় ।
প্রত্যেকদিন সকাল বেলা "আমদামী"তে (যেখানে নতুন আসামীদের এনে রাখা হয়) জামাত ওয়ার্ডের মেট (যে ওয়ার্ডের পরিচালক) চিল্লায়ইয়া বলে , জামাত শিবিরের কোন ভাই আছো ? থাকলে হাত তুলো । যারা হাত তুলে তাদের সাথে প্রাথমিক আলাপ ( কি মামলা , কোন থানা এইসব) সেরে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় ।
বিএনপি আর আওয়ামীলীগের মধ্যে এইসব নাই । একমাত্র সুপারিশ ছাড়া বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের ওয়ার্ডে কেউ থাকতে পারে না । নেতারা বাইর থেকে সুপারিশ করলেই কেবল জায়গা হবে নইলে হবে না ।
পলিটিক্যাল ওয়ার্ডে সাধারন ওয়ার্ড থেকে খরচ একটু বেশি । কারণ এইখানে থাকা খাওয়া উন্নত মানের । জামাত ওয়ার্ডে যে যা পারে তা দেয় নির্দিষ্ট হিসাব নাই কারণ সংগঠন থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমান একটা অর্থ জেলখানায় তাদের নেতা কর্মীদের থাকা খাওয়া এবং মামলা পরিচালনা বাবদ পাঠানো হয় ।
বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের ওয়ার্ডে মাসিক খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা । এই টাকার এক টাকাও ওয়ার্ডের মেট খায় না সবই আসামীদের জন্য খরচ করে । তবে জামাত ওয়ার্ডের মেট খরচের কোন হিসাব কাউকে দেন না বরঞ্চ উনি জেলখানার ইনকাম দিয়া বাড়িতে টাকা পাঠান ।
জেলখানায় পলিটিক্যাল ওয়ার্ড গুলো থেকে দলীয় প্রোগ্রামগুলো পালন করা হয় । জামাতিরা জামাতিদের গুলা বিএনপি বিএনপির গুলা আর আওয়ামীলীগ আওয়ামীলীগের গুলা । জামাতিরা রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের জন্য মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যু দিবসে । সেইদিন জেলখানার সকল জামাতি আকিদার লোকদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় । তারা আসে মিলাদ পড়ে তারপর খাইয়া দাইয়া চইলা যায় । বিএনপি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন মৃত্যু দিন আর খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করে । আওয়ামীলীগ ওয়ার্ড থেকে আওয়ামীলীগের সকল দলীয় কর্মসুচি পালন করা হয় ।
আওয়ামীলীগের ওয়ার্ড পরিচালনার জন্য দল থেকে একটা টাকাও দেওয়া হয় না । যারা থাকে তারাই ভাগাভাগি কইরা খরচ দিয়া পলিটিক্যাল প্রোগ্রামগুলা করে ।
বিএনপির ওয়ার্ডটির খরচ এখন আসলাম চৌধুরী দেয় । কিন্তু আওয়ামীলীগের বেলায় কেউ দেয় না । তারপরেও আওয়ামীলীগের ওয়ার্ড থেকে দলীয় প্রোগ্রাম গুলা পালন করা হয় ।
আমি জেলে থাকাকালীন সময়ে দেখেছি, আগষ্ট মাসকে শোকের মাস হিসাবে পালন করতে । ওয়ার্ডের সামনে এক তারিখ থেকে একত্রিশ তারিখ পর্যন্ত কালো পতাকা বাঁধা ছিলো । ১৫ আগষ্ট শোক দিবস পালন করা হয়েছিলো । জেলখানায় আমরা যারা আদর্শিক আওয়ামীলীগ ছিলাম তারা ১৫ আগষ্টের গোটা দিন কালো ব্যাজ পড়েছিলাম । আওয়ামীলীগের ওয়ার্ড থেকে দুই জায়গায় কোরান খতম দেওয়া হয়েছিলো । একটি ছিলো "কোরান দফায়" আরেকটা দেওয়া হয়েছিলো , ওয়ার্ডে । তারপর ওয়ার্ড থেকে প্রায় দেড়শোজন লোক'কে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়েছিলো । এই দেড়শোজন লোকের মধ্যে ছিলো দলীয় নেতা কর্মী সমর্থক , মৌলানা , বৃদ্ধ অসহায় আসামী এবং যারা কোরান খতম দিয়েছিলো, জেলখানার প্রশাসনিক লোক ।
জেলখানা এখন আসলে অনেক মানবিক । যদিওবা এটি জেলখানা । আসামীদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আবেগ অনুভুতি চর্চা করার সীমিত সুযোগ দেওয়া হয় ।
তবে একটা দুঃখের বিষয় , আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও জেলখানার প্রশাসন , জমাদার সুবেদার মিয়াসাব , মেডিকেল ওয়ার্ডের পরিচালক , ক্যান্টিনের পরিচালক , কেইস টেবিলের সুবেদার , লাইব্রেরির পরিচালক এরা সকলেই জামাত বিএনপির অনুসারী ।
আর তাই জামাত বিএনপির আসামীরা জেলখানায় অন্যান্য দলীয় আসামীদের চাইতে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে ।
ক্যান্টিনে যেকোন জিনিষের দাম বাইরের দামের তুলনায় প্রায় আড়াইগুন বেশি । যার ফলে সাধারণ আসামিদের মধ্যে সরকার বিরোধী একটা মনোভাব তৈরি হয় । অথচ এই ক্যান্টিনটি আওয়ামীলীগের অনুসারী কেউ পরিচালনা করলে এই রকম রক্ত চুইষা খাইতে পারতো না আসামীদের । কারণ এর জন্য দল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ।
মেডিকেল ওয়ার্ডে চলছে আরেক নৈরাজ্য । সাধারণ রোগীরা থাকতে পারছে না । যারা থাকছে তারা বেশির ভাগই রোগী নয় । মেডিকেল ওয়ার্ডটি যে চালায় সে পটিয়া ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি । এখন সে মাসিক বারো হাজার টাকা করে নিয়ে পয়সাওয়ালা আসামীদের আরামে থাকার ব্যবস্থা করছে । যার ফলে সাধারণ রোগীদের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব তৈরি হচ্ছে । যার প্রভাব পড়ছে আওয়ামীলীগের উপর ।
আওয়ামীলীগের উর্ধতন নেতারা যদি বাইর থেকে জেলখানার ভেতরে নজর না দেয় তাইলে জেলখানার প্রশাসনিক তেমন একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না । আর জেলখানার প্রশাসন যদি আওয়ামী অনুসারীদের হাতে না আসে এই আওয়ামীলীগ আমলেও তাইলে আওয়ামীলীগের দলীয় নেতা কর্মীরা যারা দল ক্ষমতায় থাকার পরেও জেল জুলুমের স্বীকার হয় তারা জেলের ভেতরেও নির্যাতিত হইবে ।
বিষয়টা নিয়া আওয়ামীলীগের ভাবা উচিত ।