ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ধারাবাহিক উপন্যাস: ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি (পর্ব—৫)





















ধারাবাহিক উপন্যাস:

ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি (পর্ব—৫)
সাইয়িদ রফিকুল হক

 
৫.
 
ইয়াসিন বড়সাহেবের মেয়ের পিএইচডি-থিসিস পড়তে-পড়তে আরও বেশি মুগ্ধ হতে থাকে। মেয়েটির লেখার সঙ্গে তার চিন্তাভাবনার আশ্চর্যরকম ও বিরাট একটা মিল রয়েছে। তাই, সে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে এটি পড়তে থাকে। এদিকে রাত গভীর থেকে আরও গভীর হতে থাকে। কিন্তু সেদিকে ইয়াসিনের কোনো খেয়াল নাই। সে খুব দায়িত্বের সঙ্গে এটি পড়তে থাকে।
সে ভাবে: এটি পড়া এখন তার দায়িত্ব। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো: দায়িত্বের চেয়ে এখন তার সামনে এই বিষয়ে কর্তব্য বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, তার এখন মনে হচ্ছে: এই গবেষণাকর্মটি সমাজের জন্য উপযোগী হবে ভেবে—এর প্রতি তার একধরনের ভালোবাসা জন্মে গেছে। জগতের সব ভালো জিনিসই তার ভালো লাগে। সেই স্কুলজীবন থেকে ইয়াসিন এই ভালো জিনিসগুলোকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতে শিখেছে। তার মন সবসময় মাঙ্গোলিক বিষয়ের প্রতি ভীষণ দুর্বল। সে দেশকে ভীষণভাবে ভালোবাসে। আর যাঁরা দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত—কিংবা ইতোমধ্যে দেশের জন্য জীবনবিসর্জন দিয়েছেন—তাঁরা ইয়াসিনের মাথার মুকুট আর চোখের মণি। সে তাঁদের জাতির নমস্য মনে করে। আর সে দেশের শত্রুদের কায়মনোবাক্যে ঘৃণা করে।
রাত আরও গভীর হতে থাকে। আর ইয়াসিনের পড়ার আগ্রহ যেন আরও বেড়ে যায়। চারপাশটা এখন খুব নিস্তব্ধ আর ভীষণ নিরিবিলি। এখন যেকোনো বই বা পড়ার বিষয় খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া যায়। তাছাড়া, এখানকার প্রতিটি কথা তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার আরও পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে আর পড়তে পারলো না। কারণ, রাত বেশ গভীর হয়েছে। আগামীকাল ঠিক সময় তাকে অফিসে যেতে হবে। তারপর সরাসরি বড়সাহেবের কাছে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে দুইদিনের ছুটি চাইতে হবে। সে লাইট বন্ধ করে চুপচাপ নীলিমার পাশে শুয়ে পড়লো।
 
 
আজ সকালেও ইয়াসিন নাস্তা না করেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
প্রতিদিনের মতো আজকেও রাস্তায় লোকের খুব ভীড়। সপ্তাহের শেষদিন এলে মানুষের ছুটাছুটি যেন আরও বেড়ে যায়। সরকারি অফিসগুলোতে এখন শুক্র-শনিবার ছুটি থাকায় লোকজন নাকি তাই বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়ির দিকে ছোটে। বিশেষ করে যাদের গ্রামের বাড়ি ঢাকা-জেলার আশেপাশে তারা নাকি বৃহস্পতিবার দিনটির জন্য একেবারে হন্যে হয়ে থাকে। আর অন্যান্য জেলার লোকগুলোও যে বসে থাকে—তা নয়। এদের জন্যেই আজ এই শহরের এই দুরাবস্থা। এরা নিজেদের ঠিকানা আজও সঠিকভাবে খুঁজে নিতে পারেনি। এরা একবার গ্রামে আরেকবার শহরে ছুটাছুটি করছে। কিন্তু এরা কোথাও স্থির হচ্ছে না, স্থির হতে চাইছে না, আর স্থির হতেও পারছে না।

ইয়াসিন বেশ বুঝতে পারে, কিছুসংখ্যক মানুষ এখন ঢাকার বিরাট আবর্জনা। এরা গ্রামের বাড়িঘর ফেলে কীসের আশায় আর কীসের নেশায় যেন ঢাকায় পড়ে রয়েছে। আর এদের সংখ্যাটা দিন-দিন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এদের এই বাড়াবাড়িটা যেকোনোভাবে ঠেকাতে হবে। বাংলাদেশের ছোট্ট একটি রাজধানী ঢাকা-শহর—আজ এতো-এতো মানুষের চাপসহ্য করতে পারছে না। যারা দরকারি লোক নয়, আর যাদের ঢাকায় কোনো প্রয়োজন নাই, এমনকি কোনো কাজও নাই—তারাও এখন মূর্খের মতো কীসের আশায় আর কীসের নেশায় ডুবে যেন ঢাকায় পড়ে-পড়ে নিয়মিত আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছে। আর এই লোকগুলোর জন্যই ঢাকা-শহর এখন একটা বিভীষিকাময় নগরীতে পরিণত হতে চলেছে। এই ভাসমান লোকগুলোর কারণেই ঢাকা-শহরের অধিকাংশ বাড়িওয়ালা দস্যুর মতো সাধারণ চাকরিজীবী-মানুষের বিরুদ্ধে অলিখিত-যুদ্ধ শুরু করেছে। এরা বছর পার হওয়ার আগেই নিয়মিত বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছে—আর পারলে এরা এখন প্রতিদিন বাড়িভাড়া বাড়াতে চায়! এরা এই শহরে জীবিকার প্রয়োজনে চাকরি করতে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তশ্রেণীর গলায় ছুরি চালিয়ে জোরপূর্বক দ্বিগুন-তিনগুন বাসাভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। তবুও এখানে এইসব অনিয়ম ও নৈরাজ্য দেখার কেউ নাই। পৃথিবীর সভ্যরাষ্ট্রগুলোর মতো এখানে এখনও কোনো মানবতাবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে, মানুষের চেয়ে পশুদের দাম বেশি। আর এখানকার শিক্ষিত মানুষগুলো অশিক্ষিত-পশুগুলোর দাপটে ও তাণ্ডবে একেবারে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে। কবে যে একজন মহামানব এই দেশে আবার আসবেন আর এদের জাগাবেন!
 
কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরও আজ ইয়াসিন কিছুতেই গাড়িতে উঠতে পারছে না। একটার-পর-একটা গাড়ি। কিন্তু কোনো গাড়িতে দাঁড়াবার জায়গা নাই। প্রায় প্রতিটি বাসে যেন মানুষের একইরকম মিছিল! এসব দেখে ইয়াসিন ঠিক ভয় পায় না—তবে ঘাবড়ে যায়—আজ সে ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারবে তো? আজ যে তার আরও আগে অফিসে যেতে হবে!
গাড়ির আশা পরিত্যাগ করে একসময় ইয়াসিন অনেক কষ্টে একটা রিক্সা জোগাড় করে ফেললো। এও কি সহজে পাওয়া যায়! একটা রিক্সা ঠিক করার আগেই কোত্থেকে যেন উটকো সব লোক এসে তা চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায়!
 
অফিসের ব্যাপারে ইয়াসিন ভীষণ নীতিবান। সে কখনও অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে বড় হওয়ার চিন্তাভাবনা করে না। সে তার অফিসকে ভালোবাসে। কারণ, এই অফিস তার জন্য একটা সম্মানজনক বেতনভাতার ব্যবস্থা করেছে। আজকালকার দিনে এটি খুব বড় কিছু নয়। তবুও সে এই নিয়ে এই ব্যস্ততার শহরে টিকে আছে। তাই, অফিসের প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। সে মহান ঈশ্বরের পৃথিবীতে কারও কাছে অকৃতজ্ঞ হতে চায় না। সে কৃতজ্ঞজীবের উত্তরাধিকারী হয়েই এই পৃথিবীর সকল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চায়। এটি তার সারাজীবনের মনোবাসনা।
 
অফিসে পৌঁছে ইয়াসিন দেখলো, এখনও অনেকে আসেনি। এমনকি তার এলাকার জুনিয়র-কলিগ হাসানুজ্জামান সাহেবও এসে পৌঁছুননি। আর নয়টা বাজতে এখনও পঁচিশ মিনিট বাকী রয়েছে। সে ভাবলো: জামানসাহেব হয়তো ঠিক সময়ে এসে পৌঁছুবেন।
সে ধীরেসুস্থে এসে নিজের রুমে ঢুকলো। আর সে নিশ্চিন্তমনে নিজের রুমে বসে একটুখানি বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবছিলো। সে তা-ই করলো। একইসঙ্গে সে অফিসের কাজকর্ম শুরুর কথাও ভাবতে লাগলো। সবার আগে সে অফিসে তার ব্যবহৃত ও ব্যক্তিগত কম্পিউটারটি অন করলো। তারপর সে ইউটিউবে ঢুকে তার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটি চালু করলো: তুমি ডাক দিয়েছে কোন সকালে...।
 
ইয়াসিন এই অফিসে সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্বপালন করছে। তারউপরে রয়েছে দুজন পূর্ণ ম্যানেজার। এর একজন দেখছে প্রশাসন আর অপরজন দেখছে অর্থ। এদের উপরে রয়েছে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার ও জেনারেল ম্যানেজার। এদের উপরে রয়েছে তিনজন পরিচালক। এরা যথাক্রমে প্রশাসন, অর্থ ও অফিস দেখাশোনা করছে। আর সবার উপরে রয়েছেন তাদের এই অফিসের বড়সাহেব। তিনি এই অফিসসহ অন্যান্য অফিসগুলো মিলিয়ে পুরা গ্রুপ অব কোম্পানির চেয়ারম্যান। আর বড়সাহেবের একমাত্র কন্যা তানজিলা হোসেন এই অফিসেরই ডিরেক্টর অব এডমিন হিসাবে রয়েছেন। তিনি মাঝে-মাঝে অফিসে আসেন। তবে ইয়াসিনের সঙ্গে তার কখনও দেখা হয়নি কিংবা কথাও হয়নি। এইবার হয়তো হবে। কারণ, বড়সাহেব ইতোমধ্যে ইয়াসিনকে তারই পিএইচডি’র থিসিস দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে ইয়াসিন লোকমুখে শুধু শুনেছে, বড়সাহেবের এই মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী! এককথায় রাজকন্যা।
 
অফিসের অনেকেই জানে ইয়াসিন খুব লেখালেখি করে। এইসব বড়সাহেবের কানেও গিয়েছে। তিনি বিষয়টি ভালো চোখেই দেখেছেন। আর এটিকে প্রতিভা হিসাবে মূল্যায়ন করেই তিনি তার মেয়ের পিএইচডি’র থিসিস সংশোধন কিংবা পরিমার্জন করার অধিকার তাকে দিয়েছেন।
 
ইয়াসিন নিজের কম্পিউটার অন করে অফিসের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। আর পাশাপাশি সে গানও শুনতে লাগলো। ইউটিউবে তার চালু করা প্রথম গানটি শুনে সে চালু করে দিলো তার প্রিয় আরেকটি গান: এখনই উঠিবে চাঁদ আধো আলো আধো ছায়াতে...। গানটি শুনতে-শুনতে সে একেবারে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলো।
এমন সময় একজন অফিসসহায়ক তার কাছে এসে বললো, “স্যার, বড়সাহেব আপনাকে সালাম দিয়েছেন!”
কথাটা শোনামাত্র ইয়াসিনের তন্ময়ভাব সঙ্গে-সঙ্গে কেটে গেল। সে যেন একেবারে লাফিয়ে ওঠে। আর সঙ্গে-সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, “এতো সকালে বড়সাহেব এসেছেন?”
ছেলেটি এই অফিসে একেবারে নতুন। ওর নাম মোতালেব। সে মাথানিচু করে বললো, “জ্বি স্যার। আপনে অফিসে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্যারও ঢুকেছেন। আমিই তো বড়স্যারের ব্যাগটা  গাড়ি থেকে নামায়ে নিয়ে আসলাম। আপনে স্যার তখন ওয়াশরুমে ছিলেন।”
ইয়াসিন শুধু বললো, “ও, তা-ই হবে।”
ছেলেটি বললো, “স্যার, বড়সাহেব এসেই আপনাকে দেখে খুশি হয়েছেন। অফিসে এখনও অনেকে আসে নাই তো।”
ইয়াসিন আর কথা না বাড়িয়ে সোজাসুজি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। তারপর সরাসরি সালাম দিয়ে বড়সাহেবের রুমে ঢুকলো।
 
বড়সাহেব তাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “আসুন-আসুন, ইয়াসিনসাহেব। এই সকালে আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। অফিসটাকে যে আপনি ভালোবাসেন তা আর আপনাকে বলতে হবে না। আমি সব জেনে গিয়েছি।”
ইয়াসিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
বড়সাহেব তাকে বসার ইঙ্গিত করলেন।
ইয়াসিন একটা চেয়ার একটুখানি টেনে তাতে বসে পড়লো।
আলমগীরসাহেব সস্নেহে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তারপর আমার রাজকন্যার থিসিস দেখার খবর কী? আর কতদূর এগুলেন?”
ইয়াসিন এবার খুব বিনীতভাবে বললো, “স্যার, গতরাতে আমি থিসিসের প্রায় অর্ধেকটা পড়ে ফেলেছি। পুরাটা পড়া শেষ হলে এর গ্রহণ-বর্জনের কাজ শুরু করবো। আর পুরাটা পড়া শেষ করেই আমি তানজিলা-ম্যাডামকে ফোন করবো। তারপর তার সঙ্গে বসে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা থিসিসটিকে ফাইনাল করে ফেলতে পারবো। আর আশা করছি: দুই-তিন সপ্তাহের বেশি আমাদের লাগবে না, স্যার।”
বড়সাহেব এবার দিলখোলা হাসি হেসে বললেন, “আপনি দেখছি দারুণ কাজের। অফিসের কাজে আপনার কোনোরকম আলসেমি নাই। গুড। গুড। আর এইরকম লোকই তো আমরা চাই। আর সবসময় মনে রাখবেন: সততা আর পরিশ্রম যেকোনো মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।”
ইয়াসিন আবার বিনীতভঙ্গিতে বললো, “দোয়া করবেন, স্যার। যেন সারাজীবন এরকমই থাকতে পারি। আর আপনারা গুরুজন। আপনাদের দোয়াতো সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।”
বড়সাহেব আশীর্বাদসূচকভঙ্গিতে বললেন, “অবশ্যই-অবশ্যই। আপনার উন্নতি হবে।”
 
কথাটা শেষ করে বড়সাহেব বললেন, “ভালোলোকের কিন্তু শাস্তিও আছে! আজ আপনাকে একটু শাস্তিই পেতে হবে। কোম্পানির জন্য একটু বেশি কষ্ট করতে হবে।”
ইয়াসিন হেসে বললো, “স্যার, কিছুই বুঝতে পারিনি।”
বড়সাহেব এবার রহস্যময় হাসিতে বলতে লাগলেন, “আপনি কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ত। তাই, আপনাকে একটুখানি শাস্তি পেতে হবে। আজ–এক্ষুনি আপনাকে গাজীপুরে যেতে হবে। সেখানে আমাদের একটা বড়সড় জুতার ফ্যাক্টরি আছে। দীর্ঘদিন যাবৎ সেটি তেমন কোনো মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। অথচ, আগে এটি বেশ লাভজনক ছিল। আর আমাদের জুতার সুনামও দেশে কমে যাচ্ছে। আগের মতো আমাদের জুতার কোনো সুনাম শুনতে পাচ্ছি না। সেখানে আমাদের একজন ম্যানেজার ও দুইজন সহকারী ম্যানেজার রয়েছে। আর অন্যান্য পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীতো রয়েছেই। সেখানে, কে যে কী করছে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ম্যানেজারদের প্রতি আমার একটা সন্দেহ জন্মেছে। আজ আপনি সেখানে যাবেন। আর সবকিছু মানে সেখানকার যতরকম অনিয়ম-দুর্নীতি আছে সব গোপনে ভিডিও করে নিয়ে আসবেন। এইব্যাপারে আপনাকে আমি আজকের জন্য আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টর অব এডমিন করে দিলাম। এই কাজের জন্য আমি আমাদের এখানকার জেনারেল ম্যানেজার কিংবা ম্যানেজার সাহেবকেও পাঠাতে পারতাম। কিন্তু সত্যি বলতে কি তাদের প্রতি আমার পুরাপুরি বিশ্বাস নাই। বুঝতেই পারছেন বিষয়টি অনেক গোপনীয়। আর এই কোম্পানির ভালোর জন্য। আমাদের জুতার ফ্যাক্টরি আবার লাভজনক করে তুলতে চাই। আপনার প্রতি আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে। তাই, আপনাকে এই কাজে পাঠালাম। মনে রাখবেন: এই কোম্পানির ডিরেক্টর অব এডমিন কিন্তু আমার একমাত্র মেয়ে তানজিলা হোসেন। আপনি তার পদে আসীন হয়ে আজ সেখানে যাবেন। কিন্তু সেখানকার কেউ যেন প্রথমেই আপনার পরিচয় বুঝতে না পারে। আপনি সেখানে অনেকটা ছদ্মবেশে থাকবেন। আমি ওদের বলে দিচ্ছি ঢাকা থেকে একজন জুতার দক্ষ ডিজাইনার পাঠাচ্ছি। ওরা আপনাকে তা-ই মনে করবে। তাহলে, আপনি রেডি হয়ে যান। আর আপনার মিশন সফল হোক।”
 
‘জ্বি স্যার’ বলে ইয়াসিন দ্রুত উঠতে যাচ্ছিলো। এমন সময় বড়সাহেব তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “বসুন-বসুন, চা-টা পান করে যান। সেখানে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আপনাকে আমি আমার মেয়ের পার্সোনাল গাড়িটা দিচ্ছি। এই গাড়িটি কোম্পানির কেউ চেনে না। এই গাড়ির ড্রাইভার আগে  আমাদের এই হেডঅফিসের জেনারেল ম্যানেজারের গাড়ি চালাতো। তাই, সে ওই ফ্যাক্টরির রাস্তাঘাট সব চেনে। ওর নাম মমিনুল। আর দেশের বাড়ি টাঙ্গাইল। আপাততঃ এই ওর পরিচয়। আমি ওর কাছেও আপনার পরিচয় গোপন রাখবো। আপনি ও-কে দেখেশুনে ব্যবহার করবেন। আর আপনার জন্য আমার তরফ থেকে বিশেষ গাড়িটা বাইরে অপেক্ষা করছে।”  
ইয়াসিন সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। সে চা-টা আসার আগে বড়সাহেবের দিকে ভক্তিভরে তাকিয়ে খুব বিনীতভঙ্গিতে বললো, “স্যার আমি পারবো তো?”
বড়সাহেব এবার হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, “পারবেন মানে আপনিই পারবেন। আমি মানুষ চিনি, ইয়াসিনসাহেব। আমি মানুষ চিনি। আর মানুষ চিনি বলেই কোম্পানিটাকে এতোবড় করে তুলতে পেরেছি। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়। এবার আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আমি তাদের প্রতিরোধ করবো। আপনি শুধু সাহসিকতার সঙ্গে আর অনেকটা গোয়েন্দাদের মতো সবকিছু দেখেশুনে ভিডিও করে নিয়ে আসবেন। আজ আপনি আমার কোম্পানির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।”
 
চা আসতে বেশি সময় লাগেনি। বড়সাহেবের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে চা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো মোতালেব। তার মুখটা বেশ হাসিখুশি। এরকম লোককে দেখলে সবারই ভালো লাগে। সে মনে মনে ভাবলো: বড়সাহেব আসলে যোগ্যলোক বলেই এরকম একটি ছেলেকে খুঁজে বের করতে পেরেছেন। সে আরও বুঝলো: এই ছেলেটিই তাহলে এখন থেকে বড়সাহেবের খাসপিয়ন।
ইয়াসিন দেখলো, চায়ের সঙ্গে ভালোমানের নাস্তাও রয়েছে। সে দ্রুত নাস্তা খাওয়া শেষ করলো। তারপর চা-টাও শেষ করলো দ্রুত।
 
ইয়াসিন কালবিলম্ব না করে বড়সাহেবকে ভক্তিভরে সালাম ও ধন্যবাদ জানিয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর সে আরও দ্রুত নিজের রুমে ঢুকলো। আর নিজের কিছু দরকারি কাগজ ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অফিসের বাইরে বেরিয়ে আসতে তার বেশি সময় লাগলো না। ব্যস্ততার জন্য সে তার এলাকার জামানসাহেবের সঙ্গেও দেখা করলো না কিংবা হঠাৎ তার বাইরে যাওয়ার ব্যাপারেও তাকে কিছু বললো না। অবশ্য আজকের এইব্যাপারটা সে কাউকেই বলবে না। তাই, সে চুপচাপ অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে এলো। বড়সাহেব প্রদত্ত আজকের এই দায়িত্ব সে সুচারুভাবেই পালন করার চেষ্টা করবে।
 
ইয়াসিন বাইরে এসে দেখলো, একটা নতুন চকচকে Rav-4 গাড়ি তার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে গাড়িটার কাছে এগিয়ে যেতেই এর ড্রাইভার তার সামনে এসে তাকে সালাম দিলো। তারপর ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে বললো, “স্যার, আপনি গাড়িতে ওঠেন। আমি রেডি।”
আর ইয়াসিন ধীরেসুস্থে গাড়িতে উঠে বললো, “চলেন। আর সাবধানে গাড়ি চালাবেন।”
ড্রাইভার মমিনুল ইসলাম শুধু একটু হেসে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে সবিনয়ে সম্মতি জানালো।
 
গাড়ি ছুটছে দারুণ স্পিডে। ড্রাইভার-লোকটি বেশ দেখেশুনে গাড়ি চালাচ্ছে। লোকটার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর তো হবেই। মাঝারি উচ্চতাসম্পন্ন লোকটার মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি আছে। আর সে খুব স্মার্ট। প্রয়োজন ছাড়া সে কোনো কথা বলে না। এতে ইয়াসিনের মনটি আনন্দে ভরে উঠলো। বাচাল-প্রকৃতির ড্রাইভার সে দু’চক্ষে দেখতে পারে না।
 
গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। আজ ইয়াসিনের মনে অন্যরকম আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। আজ সে একদিনের জন্য বিরাট বাদশাহী পেয়েছে। নইলে কি সে এতো দামি গাড়ি ব্যবহার করতে পারতো! সে একসময় নিজের মনেই হেসে ওঠে। আসলেই তো সে এখন একদিনের বাদশাহ! এইসময় তার বাগদাদের খলিফা হারুন-উর-রশীদের শাসনকালে তারই বদান্যতায় একজন আবু হোসেনের একদিনের বাদশাহীর কথা মনে পড়ে গেল। এতে সে আপনমনে আবার হাসতে লাগলো।
 
গাড়িতে তার ভালোই লাগছে। একাকি এতবড় পদে সমাসীন হয়ে ইতঃপূর্বে সে আর কখনও এভাবে কোথাও যায়নি। আজকের দিনটি তার জীবনে বিরাট একটাকিছু। সে আপনমনে তা-ই ভাবছে। সে  গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে নীলাকাশের দিকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ করলো।
 
গাড়ি চলছে। আর এরই ফাঁকে ইয়াসিন তার কাজকর্ম গুছিয়ে নিচ্ছে। সে তার পকেট হাতড়ে মোবাইল-ফোন দুটো বের করে দেখলো এতে পুরাপুরি চার্জ আছে। বিশেষ করে তার ফোরজি (4G) মিনিট্যাব-মোবাইলটা ঠিকঠাক মতো আছে কিনা তা সে বারবার পরীক্ষা করে দেখলো। তারপর এটা সম্বন্ধে পুরাপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে সে সন্তুষ্ট হলো। এটির গায়ে একটি কালো-কভার লাগানো রয়েছে। আর এই অবস্থায় এটাকে প্রথম দর্শনে যে-কারও কাছে একখানি কাগজের নোটবুকের মতো মনে হবে। আর অনভিজ্ঞ লোকগুলো এটি দেখে সাধারণ একটি ডায়েরিই মনে করবে। ইয়াসিন এটাকে আজ ভালোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। সে সবকিছু দেখেশুনে ফোনটা আবার পকেটে রেখে দিলো।

ইয়াসিন এতোক্ষণ জুতার ফ্যাক্টরি নিয়ে বিরাট ভাবনায় ডুবে ছিল। কাজকর্ম গোছানোর পর এবার সে যেন একটু চিন্তামুক্ত হয়ে বসার অবসর পেলো। আর তখনই সে গাড়ির ড্রাইভারের পিছনের সিটগুলোতে কীসের যেন মনমাতানো গন্ধ অনুভব করলো। খুব সুন্দর পারফিউমের ঘ্রাণ এটি। ইয়াসিন বুঝতে পারলো, তাদের কোম্পানির তানজিলা ম্যাডাম এখানে বসেই সবসময় যাতায়াত করে থাকেন। তারই স্পর্শ ও ঘ্রাণ এখনও লেগে আছে।

একটু পরে ইয়াসিন আরও লক্ষ্য করলো, কয়েকটি ম্যাগাজিন এখনও সিটের উপর পড়ে রয়েছে। এগুলো হয়তো এভাবেই এখানে পড়ে থাকে। ইয়াসিন এর থেকে একটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো। এর বেশিরভাগই রুচিশীল মনের মেয়েলি পত্রিকা। তবুও এসব পড়তে ইয়াসিনের ভালো লাগছে।
 
গাজীপুর চৌরাস্তায় কিছুক্ষণের জন্য ট্রাফিক-জ্যামে ইয়াসিন আটকিয়ে রইলো। আর এখানে তার সর্বসাকুল্যে ত্রিশ মিনিট সময় অপচয় হলো। এরপর ড্রাইভার গাড়ি টানতে-টানতে তাকে একেবারে শিল্পনগরী কোনাবাড়িতে নিয়ে এলো।
ওরা মেইন-রাস্তা থেকে আরেকটু ভিতরে ঢুকে ফ্যাক্টরির কাছাকাছি এসে পৌঁছুলো।
ইয়াসিন গাড়িতে বসেই দেখতে পেলো অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দাদা-সু-কোম্পানি।
ফ্যাক্টরির একেবারে সামনে না গিয়ে ইয়াসিন গাড়িটাকে একটু দূরে রাখতে চায়। কথাটা সে ড্রাইভারকে দ্রুত জানালো। আর ড্রাইভার তা-ই করলো।
 
ড্রাইভারকে গাড়িতে রেখে ইয়াসিন তার জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাকী পথটুকু হাঁটতে লাগলো। একসময় সে ফ্যাক্টরির মেইন-গেটের সামনে এসে পড়লো।


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
 

ছবি
সেকশনঃ সাহিত্য
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 16/07/2017
সর্বমোট 4175 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন