ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

আগে ছিল ঈদ আর এখন ঈদের নামে শুধুই ফ্যাশন কিংবা অভিনয়




















আগে ছিল ঈদ আর এখন ঈদের নামে শুধুই ফ্যাশন কিংবা অভিনয়

সাইয়িদ রফিকুল হক

 
আগে ঈদ ছিল। আর মানুষ ঈদ করতো। সকল মানুষ মিলেমিশে মনের আনন্দে ঈদে শামিল হতো।
আগের ঈদে এখনকার মতো মার-মার, কাট-কাট, ধর-মার-খাও ইত্যাদি নেতিবাচক কোনো ভাব ছিল না। তখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদপালন করতো। আর তখনও ঈদের আয়োজন ছিল—আর ছিল যার-যার সামর্থ্যের মধ্যে আকর্ষণীয় সাজসজ্জা। কিন্তু সেখানে কোনোপ্রকার বিলাসিতা, ভণ্ডামি, লোকদেখানো অতিরঞ্জিত আয়োজন কিংবা লোকদেখানো চাকচিক্যময় সাজসজ্জা ছিল না। তখনকার ঈদে ছিল শুধু আন্তরিকতা আর মানবিকতা।
আর এখনকার ঈদে মানুষের লোকদেখানো জৌলুস বেড়ে গেছে। নিজেকে লোকের কাছে বড় কিংবা বাহাদুর কিংবা অভিজাত প্রমাণ করার জন্য মানুষ এখন ঈদের সাজসজ্জায় নিমজ্জিত হচ্ছে। আমাদের দেশের ধনিকশ্রেণীটি এখন সম্পূর্ণরূপে লোকদেখানো-আভিজাত্যপূর্ণ ঈদআয়োজনে ব্যস্ত। এদের কাছে এখন ঈদ মানে—সে কতটা ধনী তা সমাজের সবার কাছে নগ্নভাবে প্রদর্শন করা! আর তাদের এই নগ্নপ্রদর্শনীতে রয়েছে—দামি-দামি পোশাকআশাক, দামি ও লোভনীয় খাবার, আর কতরকমের ফ্যাশন! এরা একজোড়া জুতা কিনছে আট থেকে বারো হাজার টাকা দামের। আর এদের একজোড়া স্যান্ডেলের দাম তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। কিংবা এরচেয়েও বেশি হতে পারে।
আবার এই অমানুষের দল ঈদের কেনাকাটা করার জন্য বিদেশেও যাচ্ছে! কেউ-কেউ ইউরোপে  পর্যন্ত পাড়ি জমাচ্ছে! অনেক অমানুষ নিদেনপক্ষে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ইত্যাদি স্থানে যাচ্ছে—আর দেশের টাকাপয়সা অকাতরে ঢেলে দিচ্ছে! এর নাম ঈদ নয়—এর নাম ভণ্ডামি আর শয়তানী। এখন দেশের একটি ধনিকশ্রেণী বিলাসিতার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে নিজেদের সবচেয়ে বড় ভাবছে—আর যা-খুশি তা-ই করছে। এরা নিজেদের ব্যতীত অন্য-কাউকে আজ আর মানুষ ভাবছে না। দেশের এই অমানুষ ও ধনিকশ্রেণীটির হাতে এখন এসে গেছে অগাধ কালোটাকা—এগুলো হারামটাকা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, ধোঁকাবাজির টাকা আর কালোবাজারির টাকা। এই টাকাই এখন এদের পশুতে পরিণত করেছে।
 
টাকালোভী-সম্পদশালী-সম্পদলুটপাটকারী ও নষ্টচরিত্রের এই ধনিকশ্রেণীটি এখন বিদেশে গিয়ে ঈদ করছে। আসলে, এটি ঈদ নয়—এটি হলো তাদের ঈদের নামে ভণ্ডামি আর ফুর্তি! এরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের অনেক দেশের হোটেলে সময় কাটাচ্ছে—আর সেখানে মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে। ঈদ এখন এদের কাছে ফ্যাশন মাত্র। আর এই অমানুষের দলের কাছে দেশের সাধারণ ও গরিব মানুষের স্থান কোথায়?
 
আগের মানুষের চাহিদাও ছিল অল্প। তারা স্বল্প আয়ে, স্বল্প বসনে, অল্প ব্যয়ে, অল্প সুখে মানুষ ছিল বেশি পরিমাণে সুখী। তখনকার মানুষ ঈদের নতুন পোশাকআশাক কিংবা জামাকাপড় না পেলেও  কোনোরকম মনখারাপ করতো না। তারা নিজের পুরাতন পোশাকটি বা জামাটি ধুয়েমুছে সাফ করে রেখে দিতো ঈদের দিনে পরার জন্য। আর এখন মানুষ ঈদের জন্য নতুন-নতুন একটার-পর-একটা জামাকাপড় কিনেও সুখী নয়—সুখী হয় না। তাদের আরও চাই। অমুকের মতো আর তমুকের মতো চাই! এদের আত্মা আজ সম্পূর্ণ কলুষিত। আর এরা এখন মানুষ কিনা সন্দেহ!
 
আগে ধনীমানুষেরাই শুধু ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড় ক্রয় করতো। এরসঙ্গে কিছুসংখ্যক চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণীর মানুষও তাদের সাধ্যমতো স্বল্পমূল্যের পোশাকপরিচ্ছদ কেনার আয়োজন করতো। আর এখন প্রায় সকলেই ঈদে নতুন-নতুন পোশাকআশাক কিনছে! সবখানে এখন নতুন পোশাকের ছড়াছড়ি। কিন্তু ঈদ কোথায়?
এখন মানুষজন নতুন-নতুন পোশাকআশাক পরে ঈদের দিনটার বেশিরভাগ সময় নিজেদের বাসায় বা বাড়িতে বসে থাকে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই! কিন্তু কেন? কারণ, আত্মীয়তার বন্ধন এখন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। দেশের একটি অমানুষশ্রেণী এখন টাকার গুনে আত্মীয়তা বজায় রাখছে। এদের বাড়িতে ঈদের দিনে এখন কে যাবে?
 
এখনকার ঈদে শুধু চোখধাঁধানো আয়োজন আছে, নানারকম জৌলুস আছে, আর বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি আছে। কিন্তু কোথাও ঈদ নাই! মানুষের মধ্যে আগের মতো আন্তরিকতা নাই। কৃত্রিমতায় ভরে গেছে মানুষের মন। সেখানে এখন মানুষের জন্য ভালোবাসার ফুল ফোটে না—সেখানে আছে বিষাক্ত-হুল আর সেখানে আছে জীবনবিধ্বংসী ধুতুরাফুল!
 
ঈদ হলো আনন্দের বিষয়। আর আনন্দ কখনও একা-একা কিংবা কাউকে বঞ্চিত করে করা যায় না। সবাইকে নিয়েই আনন্দ হয়—আর সবাইকে নিয়েই আনন্দ করতে হয়। কিন্তু এখন শুধু নিজে খাওয়া-পরার নামই অনেকের কাছে সর্বাপেক্ষা সুখ! এখানে, কে বাঁচলো আর কে মরলো তা কেউ দেখছে না। শুধু নিজের ভবিষ্যতের সুখসন্ধানে অমানুষগুলো আজ হন্যে হয়ে ছুটছে আর ঘুরছে। এরা এখন ক্ষুধার্ত-শ্বাপদের মতো হিংস্র! এদের মনে কবে মনুষ্যত্ব জাগবে আর মানবতার ফুল ফুটবে?
 
দিন-দিন মানুষের আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এখন মানুষ ঈদের দিনেও কারও বাড়ি যেতে ইতস্ততবোধ করছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ফোন না করে যাওয়া যায় না। কেউ যদি হুট করে কারও বাড়ি ছুটে যায় এতে অনেকে রেগে যান। কেউ-কেউ বাইরে তা প্রকাশও করে ফেলে। আবার কেউ-কেউ এটাকে ঘুরিয়েফিরিয়ে প্রকাশ করে থাকে। ধনিকশ্রেণীর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঢুকতে এখন কারও-কারও গরিব-স্বজনকে অনেক কষ্ট করতে হয়। এখন তাই, ধনীতে-ধনীতে ভারি মিল। আর তাদের ঈদের সমাজও আলাদা। সেখানে গরিবের জন্য একটুকরো আসন হয়তো আছে কিন্তু তাতে কোনোপ্রকার আন্তরিকতা নাই। অর্থাৎ, বসলে বসো—আর না বসলে সোজা চলে যাও। গরিবজন না এলেই এখনকার ধনিকশ্রেণী খুব আনন্দলাভ করে থাকে। সেখানে ঈদ এখন সত্যিকারের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আর তাদের প্রতিযোগিতা: কে কার তেলেমাথায় কত বেশি তেল দিতে পারে! ঈদে এখন কে কত টাকাপয়সা খরচ করতে পারে তারই যেন বিরাট প্রতিযোগিতা চলছে। ঈদের নামে এরা অতীব দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছে। আসলে, এরা ঈদের আনন্দ ভোগ করতে জানে না। এরা আজকাল শক্তমজবুত অট্টালিকায় বসবাস করতে-করতে এদের অন্তরটাকেও কংক্রিটের দেওয়ালের মতো খুব শক্ত করে ফেলেছে। সেখানে আজ আর গরিবের জন্য বরফ গলে না। এদের বরফ এখন ডিপফ্রিজের মতো জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে। এই ধনিকশ্রেণীর ঈদ মানে এখন নিজেদের সীমাহীন ভোগ-বিলাসিতা আর ফুর্তি! মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকলে সেখানে মনের আনন্দে যেকোনো উৎসবপালনের চেষ্টা কিংবা ঈদের খুশি-আনন্দ-উপভোগের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বৃথা। এখন মানুষ যন্ত্রের মতো একদিন অনুষ্ঠানপালন করছে মাত্র—কিন্তু খুশির ঈদ অনুপস্থিত।
ঈদ নিয়ে আজকালকার একশ্রেণীর অমানুষের ভণ্ডামি লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও এরই মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণী ও গরিবমানুষগুলো নিজেদের সামর্থ্য-অনুসারে আজও হাসিখুশিভাবে ঈদপালন করছে। এদের কাছে আজও ঈদ আছে। এরা অল্পে তুষ্টপ্রাণ। আর এদের আত্মীয়তার বন্ধন আজও শিথিল হয়ে যায়নি।
 
এখনকার সময় ঈদের দিন কেউ-একজন গরিবের বাড়িতে গেলে হয় সমাদৃত। আর ধনীর বাড়িতে গেলে হয় উপেক্ষিত! গরিবের যা-কিছু আসে তা-ই নিয়ে সে হাসিমুখে মেহমানদারি করে। আর গরিব কেউ-একজন যদি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিংবা ভুলক্রমে কোনো ধনীর বাড়িতে গিয়ে তার ড্রইংরুমে বসে—তাহলে, ধনীপরিবারের লোকজন আগত-মেহমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরিমাপ করে। তারা আগত গরিব-মেহমানের প্রথমে জুতা-স্যান্ডেল দেখে, তারপর শকুনের চোখে তার গায়ের পাঞ্জাবি-পায়জামা বা শার্ট-প্যান্ট দেখে! আর দেখে-দেখে ভাবে—এগুলো কত দামের! দামপরিমাপ করা হলে অনেকেই হাসে। তারপর তাকে একজন সামান্য মানুষ বলে বিবেচনা করে থাকে। আর তার সঙ্গে তারা খুব সামান্য ভদ্র ব্যবহারই করে থাকে। আর তার সঙ্গে মেহমানদারি? সেটিও করা হয় ধনসম্পদের বিচারে। কিন্তু মূর্খধনীগুলো কখনও গরিবের স্বল্পদামি পোশাকের আড়ালে তার ভিতরের মহামূল্যবান মনুষ্যত্বের নাগাল পায় না। এইসব অর্থলুটপাটকারী ও অহংকারী ধনীর চেয়ে একজন গরিব ও সাধারণ চরিত্রবান মানুষ এই পৃথিবীতে অনেক দামি। কিন্তু মূর্খধনীগুলো তা কখনও উপলব্ধি করতেও পারে না। এদের সঙ্গে সাধারণ ও গরিব মানুষগুলো কীভাবে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করবে? আর এদের সঙ্গে কে মিশবে? এর জবাব কি কারও কাছে আছে?
 
ধনী লোকগুলো এখন ছোটলোকে পরিণত হচ্ছে। আর দিনের-পর-দিন এদের আত্মা দূষিত, কলুষিত আর সংকুচিত হচ্ছে। আর তাদের অন্তর থেকে চিরতরে বেরিয়ে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় ধনসম্পদ—মনুষ্যত্ব। তবুও আজ এই পশুশ্রেণীটির সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নাই। তাদের সংকীর্ণচিত্তে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা নাই—আর সেখানকার দরজাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গরিবের জন্য। এরা শুধু তেলেমাথায় তেল ঢালতে ওস্তাদ। আর দেখে তার মতো কোন ধনীর কয়খানা গাড়ি আছে! এদের কাছে আজ মানুষপরিমাপের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে—ধনসম্পদ, টাকাপয়সা, গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জায়গাজমি আর সোনাচান্দি। এরা এভাবেই আজ সম্পূর্ণ নীচপ্রকৃতির ও ছোটলোকে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এদের কবে বোধোদয় হবে?
 
জীবনে অনেকবার ঈদের দিনে বড়মুখ করে ধনীর বাড়িতে গিয়ে অপদস্থ হয়েছি। তবুও গিয়েছি! যেতে ইচ্ছে করেছে। নিজের আত্মীয় হয় যে! রক্তের টান সহজে কি এড়ানো যায়? বারবার অপদস্থ হওয়ার পর একসময় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। তারপর আর যাইনি।
 
সকলে মিলেমিশে হাসিমুখে কোলাকুলি করে পবিত্র ঈদউদযাপন করতে হবে। এখানে, কৃত্রিম ভেদাভেদসৃষ্টি করলে ঈদ হবে কীভাবে? ঈদ মানে তো আনন্দ। আর হিংসার মধ্যে তুমি আনন্দ কোথায় খুঁজে পাবে? তাই, মনের মধ্যে হিংসার বীজরোপণ করে তুমি মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগতে ঈদবিনষ্টকারী হয়ো না। আর পবিত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা স্মরণ করো। তিনি কীভাবে ঈদ করেছেন? তিনি এতবড় মানুষ ছিলেন—তবুও তাঁর মনে কোনো হিংসা ছিল না।
ঈদের পবিত্র আনন্দ সকলে মিলেমিশে উপভোগ করতে হবে। আর সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে: ঈদ কোনো ফ্যাশন কিংবা অভিনয় নয়। আর ঈদের একটা দিন শুধু নিজের ধনসম্পদ জাহির করে অভিনয় করলে চলবে না। ঈদের দিন সবার কথা ভাবতে হবে। আমরা সবাই মানুষ। পবিত্র ঈদের আনন্দ হোক জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য।
 
ঈদমোবারক।
 
 
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
২৪/০৬/২০১৭

ছবি
সেকশনঃ ঐতিহ্য
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 25/06/2017
সর্বমোট 7022 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন