ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ধারাবাহিক উপন্যাস: ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি (পর্ব—৩)




















ধারাবাহিক উপন্যাস: 

ঈশ্বরের রহস্যময় হাসি (পর্ব—৩)
সাইয়িদ রফিকুল হক

 
৩.
 
নীলিমা গতকাল থেকে আরও কঠোর হয়েছে। আর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে: এখন থেকে সে আর সকালে নাশতা বানাবে না। তাদের দুটি ছেলে-মেয়ের জন্য শুধু পাউরুটির ব্যবস্থা রাখবে। এতে তার স্বামী জব্দ হবে। আর একসময় সে হয়তো তাকে একটা কাজের মানুষ রেখেই দিবে। এইরকম একটি দুর্বুদ্ধি থেকেই তার মাথায় আজকাল এমনতর ভাবনা আসছে। সে তার বান্ধবীদের দেখে-দেখে নিজেও কিছুটা আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ইদানীং সে তার বান্ধবীদের দেখেছে, তারা কাজের মেয়ে নিয়ে বেশ আরামে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে। তারা প্রায় সারাদিন টিভি দেখার সুযোগ পাচ্ছে। ফ্যাশন করতে পারছে। কেউ-কেউ আবার বিউটি-পার্লারেও যাচ্ছে। এসব দেখে একজন নীলিমার আর সহ্য হচ্ছে না।
সে কিন্তু খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে। আর গ্রামেরই একটি মেয়ে ছিল। ইয়াসিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বলেই সে এখন শহরে বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে। তাও একেবারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়!
 
ইয়াসিন আজ বেশ হাসিখুশিভাবে ঘরে প্রবেশ করলো। তারপর সদর-দরজা আটকিয়ে নীলিমার দিকে চেয়ে হাসিমুখেই বললো, “সামনে আমাদের মনে হয় সুদিন আসছে। আর খুব শীঘ্রই তোমার জন্য একটা কাজের লোক জোগাড় করতে পারবো।”
নীলিমা এই আশ্বাসের কথা শুনে খুব একটা খুশি হলো না। সে তবুও মুখভার করে বললো, “এসব তো সেই কবে থেকে শুনছি। আর এসব তো এখন ইতিহাস।”
ইয়াসিন আজ আর মনখারাপ করলো না। সে খুব সুন্দর করে হেসে বললো, “ইতিহাস বলছো ঠিক আছে। আর ইতিহাসও সত্য হয়। আমাদের এই ইতিহাসটাও একদিন সত্য হবে। আর আমরা একদিন একটা কাজের লোকও রাখতে পারবো।”
বাবার গলার আওয়াজ শুনে ওদের ছেলে-মেয়ে দুটি ছুটে এলো। ওরা দৌড়ে এলো—আর কে কার আগে আসবে ইয়াসিনের কাছে। আর এসেই ওরা বাবাকে খুব করে জড়িয়ে ধরলো।
ইয়াসিন হাসিমুখে ছেলে-মেয়ে দুটিকে আদর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে তাদের হাতে তুলে দিলো আপেলের ঠোঙ্গাটা। আর সে বললো, “এটি তোমাদের মা-কে দাও।”
কিন্তু এটি নিয়ে দুই ভাই-বোনে কিছুটা সময় খুব কাড়াকাড়ি করলো। আর কে আগে এটি মায়ের কাছে নিয়ে যাবে এই নিয়ে তাদের টানাটানি। শেষে মেয়েটি তার ছোট ভাইটির হাতে ঠোঙ্গাটা তুলে দিয়ে বললো, “যা ভাই, মাকে দিয়ে আয়।”
মেয়েটির মমতাময়ী-ব্যবহারে ইয়াসিনের মনটি ভরে গেল। আর সে ভাবলো: আহা, ওর মনে যেন ঠিক ওর দাদীর মতো মায়া জন্মেছে। আর এই বয়সেই মেয়েটি কী স্নেহশীল হয়েছে!
ওদের কাণ্ড দেখে ইয়াসিন সবসময় হাসে। আর ভাবে: ওরা কত সরল। আর কত ভালো। মানুষ যতই বড় হয় ততই যেন তার মনের জটিলতাবৃদ্ধি পায়। অথচ, বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তো মানুষের বুদ্ধিও বাড়ে। তবুও কেন মানুষ নিজেদের বুদ্ধি ভুলে এতো স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন হয়? আর তবুও কেন মানুষ শৈশবের সেই সরলতা ভুলে এতো জটিল হয়?
ইয়াসিন প্রতিদিন বাসায় ফেরার আগে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে আসবেই। এটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আর সে দেখেছে, এতে তার ছেলে-মেয়ে দুটি খুব খুশি হয়। ওদের এই মনোলোভা হাসিটুকু তার কাছে অনেক-অনেক দামি। আর এতে যে তার স্ত্রীর মুখ ও অন্তর অপ্রসন্ন হয়—তা কখনও বলা যাবে না।
 
ইয়াসিন দেখলো, তার ছেলে-মেয়ে দুটি আবার টিভি দেখতে বসেছে। আর ওরা এই বয়সে কার্টুনের খুব ভক্ত। এটি ইয়াসিন ভালো চোখে না দেখলেও এখনই সে এইব্যাপারে ছেলে-মেয়েদের কিছু বলতে চায় না। ওদের ভালোলাগাকে সম্মান করে সে আস্তে-আস্তে ওদের মনের ভিতরে বসে তারপর ওদের মনটাকে পরিবর্তন করতে চায়। আর বাঁকা-পথের চেয়ে সহজ-সোজা-পথ তার কাছে সবসময় ভালো লাগে। সে এটি শিখেছে পৈতৃকসূত্রে।
ইয়াসিন যখন ডাইনিং-রুমে বসে এসব ভাবছিলো তখন একফাঁকে নীলিমা টেবিলের উপর আপেল কেটে সাজিয়েগুছিয়ে দিয়ে বললো, “নাও, এখন খাও।” আর বলেই সে দ্রুত সরে গেল। ইয়াসিন তাকে বসতে বলার সুযোগটাও পেলো না।
ইয়াসিন বাধ্য হয়ে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলো, “ইতু-মামণি, এদিকে এসো।” তারপর সে ছেলেটিকে ডাকলো, “বাবা-নাগিব এদিকে এসো।”
 
ওরা দুজন আবার ছুটে এলো ইয়াসিনের কাছে। ইয়াসিন লক্ষ্য করলো আজকালকার এই শিশুদের খাওয়ার চেয়েও আগ্রহ বেশি কার্টুন দেখায়! সে অবাক হয়ে ভাবে: এভাবে চলতে থাকলে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কী হবে? ওরা অপুষ্টির শিকার হবে নাতো!
ইয়াসিন সবশেষে স্ত্রীকে ডাকলো। কয়েক ডাকের পরে নীলিমা এসে খাওয়ার টেবিলে বসলো।
ইয়াসিন মাঝে-মাঝেই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেতে-খেতে তাদের ঈশপের গল্প শোনায়। এগুলো তার কাছে শুধু গল্প মনে হয় না। তার মনে হয়: এগুলো যেন চরিত্রগঠনের অন্যতম সেরা মাধ্যম।
তার ছেলে-মেয়েরাও খুব আগ্রহ নিয়ে এসব গল্প শোনে। সে তার স্ত্রীকেও বলেছে ওদের এসব গল্প শোনাতে। কিন্তু তার স্ত্রী এই কাজটি কখনও করে না। এতে ইয়াসিনের খুব মনখারাপ হয়। কিন্তু এর বেশি সে আর কিছুই করতে পারে না। মনটি তার নিজের। তাই, সে এটিকে কষ্ট দিতে পারে। কিন্তু অন্যের মনের উপর সে জোর খাটাবে কোন ভরসায়?
 
 
নাশতা শেষ করে ইয়াসিন নিজের কম্পিউটার-রুমে ঢুকলো। তারপর বড়সাহেবের নিকট থেকে প্রাপ্ত তার মেয়ের পিএইচডি’র গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রগুলো টেবিলের একপাশে গুছিয়ে রাখলো। আজকে ইয়াসিনের মনটা গতকালের চেয়ে বেশ ভালো। তাই, সে সময় নষ্ট না করে তার উপন্যাসের বাকী অংশটুকু লিখতে আরম্ভ করলো।
উপন্যাস লিখতে-লিখতে একটা সময় সে নীলিমার জন্য একজন কাজের লোক জোগারের কথা ভাবছিলো। আর তখনই তার মনে পড়লো এরচেয়েও একটি বড় কাজের কথা। আজ দুপুরে সে ইচ্ছে করে তার শাশুড়ির সঙ্গে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলো। তার ইচ্ছে ছিল তার শাশুড়িকে তার বাসায় কয়েকদিন বা কিছুদিন এনে রাখবে। আর সেটি তার শাশুড়ির ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। তিনি যতদিন থাকতে চান এখানে এসে থাকতে পারবেন। আর এতে ইয়াসিনের কোনো আপত্তি নাই। ভদ্রমহিলা বিধবা-মানুষ। গ্রামে একা পড়ে থাকেন। এখানে এসে কয়েকদিন থাকলে তারও ভালো লাগবে। আর এতে তার সংস্পর্শে নীলিমার স্বভাবের কিছুটা পরিবর্তনও হতে পারে। কারণ, তিনি খুব পরহেজগার ও ভালোমানুষ। আর ইয়াসিনের দৃষ্টিতে তিনি নিঃসন্দেহে পতিব্রতা-রমণী।
 
ইয়াসিন তার শাশুড়ির সঙ্গে আজ অনেকক্ষণ কথা বলায় বুঝতে পেরেছে—ভদ্রমহিলা গ্রামেও খুব একটা ভালো নাই। সেখানে তার দুই বিবাহিত-ছেলের দুইটি বউ রয়েছে। কিন্তু তারা এই জগতসংসারে একজন বৃদ্ধা-শাশুড়িকে মর্যাদা দিতে শেখেনি। তাদের কাছে সংসার মানে—নিজের সবকিছু। আর এখানে, কারও কোনো অধিকার নাই। এরা আরও মনে করে: সংসার শুধু নিজের, স্বামীটি একান্ত-নিজের, স্বামীটি সবসময় তার কথামতো চলবে, আর তার স্বামীটি কারও কিছু হয় না—হবেও না। এখানে শুধু তাদেরই একক-কর্তৃত্ব চলবে। এরা এমনই একশ্রেণীর মূর্খ-রমণী। ইয়াসিন তাই তার শাশুড়ির সঙ্গে সামান্য কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছে—তার ছেলের বউরা তার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করে না। এব্যাপারে ইয়াসিনের কানেও কিছুকথা এসেছিলো। তাই, সে আজ তার শাশুড়িকে সরাসরি এবিষয়ে কিছুকথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি অনেক কথা বলতে গিয়ে  একটা পর্যায়ে কেঁদেই ফেললেন। আর বললেন, “বাবা, ওরা আমাকে মানুষই মনে করে না! আর ছেলে দুটোও এমন বউপাগল হয়েছে যে, ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। ওদের কাছে বউই বড়।”
 
শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে ইয়াসিন বুঝতে পেরেছে, ভদ্রমহিলা গ্রামে তার ছেলের বউদের দ্বারা রীতিমতো নির্যাতিত হচ্ছেন। আর তখনই সে ভেবে অবাক হলো—এখানে, নীলিমাও তার মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকে। বউদের স্বভাব-চরিত্রে এখন আশ্চর্যরকমের মিল!
 
ইয়াসিন মনখারাপ করেই লিখতে থাকে: আমরা এরকম বউ-ঝি চাই না। আর আমরা আগের মতো সহজ-সরল-চপলা-মধুর রমণী চাই। আমরা শিক্ষিত-রমণীও চাই—তবে তা শ্বাশ্বত-বঙ্গীয় রমণী হতে হবে। আর যারা সংসারে শুধু আমার-আমার করবে—আমরা কখনও তাদের চাই না। আমরা সকলে মিলেমিশে সুন্দর ও সুদৃঢ় পারিবারিক-বন্ধনে বেঁচে থাকতে চাই। এখানে, শুধু আমার-আমার করে কাউকে পাগল হওয়া চলবে না।
 
একটু পরে নীলিমা এসে বললো, “রাতের খাবার দেবো?”
ইয়াসিন লেখা বন্ধ করে বললো, “না, এখনই না। এই কিছুক্ষণ পরে দাও।”
নীলিমা চলে যাচ্ছিলো। ইয়াসিন তার হাত ধরে বললো, “একটু বসো কথা আছে।”
নীলিমা না বসে পাশে দাঁড়িয়েই সোজাসাপটাভঙ্গিতে বললো, “বলো, কী কথা?”
ইয়াসিন বেশ গুরুত্ব দিয়ে বললো, “ভাবছি, মা-কে এখানে এনে কিছুদিন রাখবো। এতে তোমার ভালো লাগবে। সারাদিন বাসায় একা-একা থাকো, তবুও একজন কথা বলার মানুষ পাবে।”
ইয়াসিন আশা করেছিলো তার বউ এতে খুশিই হবে। কিন্তু সে দেখলো হিতে বিপরীত।
কথাটা শোনামাত্র নীলিমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো, “আমি এসব ঝামেলা সহ্য করতে পারবো না। তারউপরে বাসায় নাই কোনো কাজের লোক। আর আমার তো কাউকে লাগবে না। আমি একাই ভালো থাকতে পারি। আর তুমি যদি তোমার মা-কে এখানে আবার আনো—তাইলে আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। এসব ঝামেলা আমার ভালো লাগে না।”
ইয়াসিন বুঝলো: এরা আসলে পাগল। আর এদের বুদ্ধি খুবই সামান্য।

সে আবার লিখতে থাকে: বৃদ্ধা-শাশুড়িকে যারা ঝামেলা মনে করে তারা এই জগতসংসারে কোন শ্রেণীর জীব? আর এদের কি আদৌ কোনো মানুষ বলা চলে?
সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে। এব্যাপারে তার বিবেক কী বলে তা জানার জন্য। একপর্যায়ে সে উপলব্ধি করতে পারলো আর লিখলো—যারা মায়ের বয়সী শাশুড়িকে ঝামেলা মনে করে তারা আসলে মানুষ নয়। আর এরা লোকালয়ে বসবাস না করে কোনো চিড়িয়াখানায় বসবাস করলে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক। তবে সে কখনও রাগী, বদরাগী, দাজ্জালরূপী শাশুড়িদের পছন্দ করে না। সে এদের তীব্র ঘৃণা করে। তার কাছে মনে হয়: এরা প্রাচীনকালের ডাইনীবুড়িদের মতো হিংস্র ও নির্মম।
 
 
 
 

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
 
 

ছবি
সেকশনঃ সাহিত্য
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 21/06/2017
সর্বমোট 3284 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন