ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

বাংলা একাডেমীর বইমেলাকে এখন আর কোনোভাবেই একুশের বইমেলা বলা যায় না



বাংলা একাডেমীর বইমেলাকে এখন আর কোনোভাবেই একুশের বইমেলা বলা যায় না
সাইয়িদ রফিকুল হক
 
পাকিস্তানআমলে এদেশে বইমেলার তেমন একটা ধারণা বা প্রচলন ছিল না। কারণ, তখনকার পাকিস্তানীজেনারেল নামক জাহেলগুলো বইমেলা-সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ওরা এসব মানতোও না। আর ওরা এগুলোকে সবসময় অনৈসলামিক মনে করতো। কিন্তু ওরা ইসলামের নামে মদ, জুয়া, ব্যভিচার, খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গণহত্যা সবকিছুকেই সবসময় জায়েজ মনে করতো। ইসলামের নাম-ভাঙ্গিয়ে এইসকল অপকর্ম করতে কখনও ওদের বিবেকে বাধতো না। অবশেষে, ১৯৭১ সালে, দেশস্বাধীনের পরে বাংলাদেশে ধীরে-ধীরে বইমেলা-কালচার গড়ে উঠতে শুরু করে।
 
১৯৮৪ সালে, স্বাধীনবাংলাদেশে একুশের বইমেলার সূচনা ঘটে। একসময় এটি বাংলা একাডেমীর হাতে চলে যায়। সেই থেকে এটির সবরকমের খবরদারি এখনও পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর হাতেই ন্যাস্ত রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলা একাডেমী বইমেলা নিয়ে স্বাধীনবাংলাদেশে আজ পাকিস্তানীদের মতোই আচরণপ্রকাশ করছে। বাংলা একাডেমী আজ পর্যন্ত সত্যিকারের ‘সৃজনশীল ও একুশের গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করতে পারেনি। দেশে এখন একুশের বইমেলার নামে যা চলছে তা হলো: কমার্শিয়াল-বইমেলা। এখানে, শুধু লাভের হিসাব কষা হচ্ছে।
 
প্রতিবছর আমাদের দেশে বাংলা একাডেমীসংলগ্ন ‘একুশের বইমেলা’ নামে একপ্রকার বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। আসলে, এটি একুশের বইমেলা নয়। বরং এটিকে একুশের নাম-ব্যবহার করে কিছুসংখ্যক পুস্তকব্যবসায়ীর ‘রমরমা বই-ব্যবসা’ বলা যেতে পারে। আর এরা একুশে ফেব্রুআরির কথা বলে দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়মিত ধোঁকা দিচ্ছে মাত্র। আর এটি কোনোভাবেই আজ একুশের বইমেলা নয়। এটি হলো একুশের নাম বেচে খাওয়ার একটি ধান্দা মাত্র। আর প্রতিবছর ফেব্রুআরি-মাস এলেই বাংলাদেশের একশ্রেণীর ধান্দাবাজ-পুস্তকব্যবসায়ীচক্র নিজেদের স্বার্থহাসিলের ব্যবসা শুরু করে দেয়। আর এইসব প্রকাশক একেবারেই ভণ্ড। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো: একুশে ফেব্রুআরির নামটা ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা লোটা। আর তাদের এই লাভ-কারবারির (লভ্যাংশ-লাভের অংশীদার) বাংলা একাডেমী। আর লাভের হিসাব কষতেই এখন এটিকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বলে বাংলা একাডেমী চাপাবাজি করে থাকে।
 
বাংলা একাডেমী-প্রাঙ্গণে প্রতিবছর যে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে—তা আজ আর কোনোভাবেই একুশের আদর্শ বহন করছে না। এখানে, বাংলাভাষার প্রকৃত-সম্মানপ্রদর্শনও করা হচ্ছে না। আর এখানে শুধু লাভের হিসাব করে একশ্রেণীর প্রকাশক নামক বইয়ের দোকানদার (কারওয়ান-বাজারের বিভিন্ন দোকানদার ও আড়তদারশ্রেণীর সঙ্গে এদের কোনো পার্থক্য নাই)। এরা বোঝে শুধু লাভ আর লাভ। আর তারা এখন আগেভাগে হিসাব করে নেয় কোন বই ছাপালে তাদের কত লাভ হবে? আর সে বই কে লিখলো আর না লিখলো তা নিয়ে এদের মাথাব্যথা নাই। এই বই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার কোন কাজে লাগবে তাও এরা ভেবে দেখে না। এরা চেনে শুধু টাকা আর টাকা। এখন দেশের একশ্রেণীর আদর্শহীন ও টাকাপাগল অমানুষই প্রকাশক-সেজে আজেবাজে, আলতুফালতু, আবোলতাবোল, উদ্ভট আর ভুলেভরা বই ছেপে জাতির সর্বনাশের অপকর্মে নিয়োজিত। আর এই পাগলশ্রেণীদের নিয়েই বাংলা একাডেমী বইমেলার আয়োজনে ব্যস্ত।
 
১৯৫২ সালে, বাংলাভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসাবে টিকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানীজানোয়ারদের বিরুদ্ধে লড়াইসংগ্রাম করেছে বাঙালি। আর বাঙালি-জাতি নিজের জীবন দিয়ে এই ভাষাকে সুরক্ষা করেছে। কিন্তু এই ভাষার প্রতি এই দেশের কিছুসংখ্যক অমানুষের এখনও কোনো শ্রদ্ধাবোধ গড়ে উঠেনি। এই পশুশ্রেণীটি এখনও বাংলাভাষার চেয়ে ইংরেজি কিংবা অপর কোনো ভাষাকে আজও বেশি ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এইরকম পশুর সংখ্যা এই দেশে এখন আর কম নয়। আর এই পশুদেরই একাংশ ফেব্রুআরি-মাসে বই-ব্যবসা—হ্যাঁ, শুধু বই-ব্যবসা করার জন্য ফরমায়েশী বই লিখে থাকে। আর এদের বই-ই বিভিন্ন প্রকাশক নামক বইব্যবসায়ী-দোকানদারশ্রেণী ছাপিয়ে বাংলা একাডেমী চত্বরে ফরমায়েশী বইমেলার আয়োজন করে থাকে। আজ বাংলাভাষাবিষয়ক সাহিত্য, দর্শন, সত্যিকারের সৃজনশীল ও প্রকৃত-বিজ্ঞানধর্মী বইয়ের চেয়ে বাংলা একাডেমীপ্রাঙ্গণে বেশি বিক্রি হয় কোথাকার ডরেমন, হ্যারিপটার, উদ্ভট-সায়েন্স-ফিকশন ইত্যাদি। এগুলোর একটিও বিশুদ্ধ বা কোনোপ্রকার সাহিত্য নয়। অথচ, এই বইগুলো পুরো ফেব্রুআরি-মাস-জুড়ে বাংলা একাডেমীপ্রাঙ্গণে বিক্রি হয়। এতে দেশের কোমলমতী শিক্ষার্থী আর ক্ষুদে-পাঠক-পাঠিকারা মনে করে বই বলতে ডরেমন, হ্যারিপটার আর খাপছাড়া-সায়েন্স-ফিকশনই বুঝি সেরা। এরা আসল বইপড়ার মজা পাচ্ছে না। এরা সাহিত্যপাঠের আজও কোনো সুযোগ পায়নি। অত্যন্ত কুপরিকল্পিতভাবে আজ এদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি-ভাষা-নির্ভর আজেবাজে বই। আর এরজন্য একমাত্র দায়ী ঠুটো জগন্নাথ বাংলা একাডেমী।
 
বাংলা একাডেমীর বইমেলায় আজ অমর একুশের চেতনা কোথায়? আর কোথায় আছে বাংলাভাষার প্রতি সর্বাত্মক-শ্রদ্ধাবোধ? বাংলা একাডেমী-জুড়ে এখন চোখে পড়ে নানারকম ধান্দাবাজদের নানান স্টল। আর এগুলো সম্পূর্ণ ভুইঁফোঁড়। এরা চেনে না এদেশের ভাষা, মাটি, মানুষ, আর ঐতিহ্য। এরা চেনে শুধু টাকা আর টাকা। বাংলা একাডেমীর বইমেলায় গেলে দেখা যায়, কতকগুলো ব্যবসায়ী হাজির হয়েছে বইমেলার নামে। বাংলাভাষার প্রতি এদের অনেকেরই নাই সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ। এরা দেদারসে বিক্রি করছে, ইংরেজিসহ যাবতীয় বিজাতীয় ভাষার বইপুস্তক! আর এরই নাম বুঝি ‘অমর একুশে-গ্রন্থমেলা’?
বাংলা একাডেমীর অনুমোদনপ্রাপ্ত ভুইঁফোঁড়-প্রকাশনাগুলো সাহিত্যের, শিল্পের, বিজ্ঞানের কদর করতে জানে না। এরা শুধু জোড়াতালি দিয়ে কতকগুলো বই ছাপায় ব্যস্ত। আর এদের কাছে কারও মৌলিক-প্রতিভার কোনো মূল্য নাই। এইসব অর্থলোভী-প্রকাশক সারাক্ষণ ধান্দাবাজিতে লিপ্ত বলে এরা প্রতিভাবান-তরুণলেখকদের মূল্যায়ন করতে শেখেনি। আর এরা প্রতিভাবান-তরুণলেখকদের বই ছাপাতে সবসময় অনীহাপ্রকাশ করে থাকে। কিন্তু এই টাউটগুলোই আবার টাকার বিনিময়ে, টাকার লোভে একেবারে পাগল কিংবা আধাপাগল হয়ে দেশের একশ্রেণীর কবি-লেখক-নামধারী (আসলে, এরা কিছুই নয়—এরা নিজের টাকা-পয়সা দিয়ে বই ছাপিয়ে কবি-লেখক হতে চায়) প্রতিভাহীনদের অখাদ্য-কুখাদ্যস্বরূপ হাবিজাবি ছাপিয়ে বইয়ের মান নিম্নমুখী করছে। আর এদেরই মদদদাতা হচ্ছে আজকের বাংলা একাডেমী।
 
আজ বাংলা একাডেমীর বইমেলায় সাহিত্য কোথায়? এখানে, এখন দেখতে পাওয়া যায় ডরেমন, হ্যারিপটার, উদ্ভট-সায়েন্স-ফিকশন আর বস্তাপচা পাতাকাটা ও জোড়াতালি দেওয়া বই। আর এসব চলছে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে! এই বুঝি আজকের বাংলা একাডেমীর ভাষাপ্রেম? তাই, দেখতে পাচ্ছি ভাষার মাসে—পবিত্র ফেব্রুআরি-মাসে বইমেলার নামে চলছে সমানে হুজ্জোতি আর বজ্জাতি। এখানে, একদল আত্মস্বীকৃত-পণ্ডিত রেডিও-টেলিভিশনে আর সস্তা দৈনিক পত্রিকাগুলোতে মনের সুখে তাদের পাণ্ডিত্য-জাহির করার অপকর্মে লিপ্ত। আর এসবকিছু পরিচালনা করছে সরকারের ঠুটো জগন্নাথ বাংলা একাডেমী। তাই, এইজাতীয় সস্তা-বইমেলাকে কোনোভাবেই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বলা সমীচীন নয়।
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০২/০২/২০১৭
 
 

ছবি
সেকশনঃ সাম্প্রতিক বিষয়
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 12/02/2017
সর্বমোট 2630 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন