ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ওড়না বিতর্কঃ নারীর শরীরের উপর নারীর অধিকার

ওড়না_বিতর্ক

ভগিনী সকলকে বলছি।

“ও তে ওড়না চাই”এমন একটা বাক্য প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে বেশ লেখালেখি চলছে। তবে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছি মেয়েদের অবস্থান দেখে। ওড়না ব্যপারটার সাথে সরাসরি সংযুক্ত নারীকূল। তাই একজন নারী ওড়না পড়বে কি পড়বে না সেটা সম্পূর্ন ভাবেই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত ছিল। অথচ সেই ওড়না বিতর্ক নিয়ে ঝড় তুলছি আমরা পুরুষ সমাজ। যাই হোক একটু পিছন দিক থেকে শুরু করব আমি।

ঔপনিবেশিক শাষকদের মাঝে ইংরেজদের সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বললে হয়ত ভুল হবে না। এই বাক্যটির পিছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি তাদের সাফল্য এবং আজ অব্দি পৃথিবী ব্যপি ব্রিটিশ রাজের দাপট। ইংরেজ সাম্রাজ্যের শাষণ এবং আজ অব্দি রাজ্যে রাজ্যে তাদের উপস্থিতি না থেকেও অস্তিত্বের চিহ্নের পিছনের কারন মূলত তাদের নিজস্ব সৃষ্টি, কালচার, ভাষা, আইন ব্যবস্থার বীজ বোপণ করে দিয়ে আসা। আর সেই বীজের ফসল আজও তাদের গুনগান গাইছে এবং হয়ত ভবিষ্যতেও গাইবে।

ঠিক ইংরেজদের মতো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। যেদিন থেকে পুরুষের হাতে সমাজের শাষণভার অর্পিত হয়েছে সেদিন থেকেই সমাজের প্রতিটি স্তর পুরুষ তার নিজের মতো করে সাজিয়েছে এমনকি একজন সন্তান পুরুষ হবে নাকি নারী হবে তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে পুরুষেরা। বাক্যটা শুনতে একটু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, Sex ব্যাপারটা বাইয়োলজিক্যাল অর্থাৎ সন্তানের লিংগ নির্ধারণ প্রাকৃতিক ভাবেই হয়ে আসে। কিন্তু সে কেমন আচরণ করবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় সমাজ এবং তার পারিপার্শ্বিক পৃথিবী অর্থাৎ সে ছেলের মতো আচরণ করবে নাকি মেয়ের মতো আচরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রাকৃতিকভাবে এসব সে শেখে না। একটু বিস্তারিত বললে হয়ত পাঠকের বুঝতে আরো একটু সুবিধা হবে। সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা দেখি একটা সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে সেক্সুয়ালি সে একজন ছেলের প্রতি আকৃষট হবে। মানে একজন মেয়ে দিন শেষে একজন ছেলেরই সেক্সুয়াল পার্টনার হবে।এবং ছেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাপারটার মাঝে একটু ঘাপলা রয়েই গেছে। একজন শিশু সেক্সুয়ালি ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হবে নাকি অন্য একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে এটাও সমাজ কর্তৃক আরোপিত। শুধু নারী, পুরুষের সেক্সুয়া আইডেনটিটি নির্ধারণ নয় সেই সাথে নারী পুরুষের সমস্ত কার্যাবলিও নির্ধারণ করে দিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে গে্লো কি? ভ্রু কুচকানোর কিছু নাই।

শিশুরা ছোট বেলা থেকেই দেখে শিখছে যে, ছেলে মেয়ের মাঝে প্রেমই নরমাল আর মেয়ের প্রতি মেয়ের আকর্ষণটা এবনরমাল। কিন্তু যদি সন্তানটাকে পারিপার্শ্বিক এই আরোপিত ধারণাটা না দেয়া হতো তাহলে সে অন্য মেয়ের প্রতিও শারীরিকভাবে আকৃষ্ট হতে পারত। তখন সেটাই তার কাছে হয়ত স্বাভাবিক হতো। একই কথা একজন ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং দেখা যায় সেক্ষেত্রে লেসবিয়ান নারী কিংবা গে পুরুষও কিন্তু নিজেদের মাঝে মিলনে শারীরিক এবং মানসিক সন্তুষ্ট থাকতে পারে।

কিন্তু পুরুষ সেটা কখনই চায়নি। চায়নি তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষ ভালো করেই জানে নারী শারীরিক মিলনে নারী যদি পুরুষের উপর নির্ভর না করে তবে নারীকে কোনভাবেই পুরুষ বশে রাখতে পারবে না। এক সময় সে বিদ্রোহ করবেই এবং সে বিদ্রোহ দমনের ক্ষমতা পুরুষের কখনো ছিল না কোনোদিন হবেও না।

পুরুষ যেদিন নারীর শরীরের উপর নিজেদের পূর্ন অধিকার ফলাতে সক্ষম হলো তখন সে হাত বাড়ালো ভাষার উপর। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন আমাদের ভাষাটাও অতিমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক। একজন নারী যদি একজন পুরুষকে গালিও দিতে চায় তাহলেও তাকে হয়ত “মাদারফাকার” বলেই গালি দিতে হচ্ছে। “ফাদারফাকার” বলে যে কোন শব্দের অস্তিত্বই নেই।

তারপর আসুন পোষাক কিংবা অন্যান্য বিষয়ের দিকে। একজন সন্তান জন্মের কিছুদিন পর থেকেই শিখে আসছে মেয়ের জন্য খেলনা হিসেবে থাকবে হাড়িপাতিল, পুতুল কিংবা বাসার তৈজসপত্র অপর পক্ষে ছেলে খেলবে বন্ধুক, বিমান, গাড়ি এসব দিয়ে। আর এর মাধ্যমেই আপনার মেয়ে সন্তানটিকে আপনি ছোট বেলা থেকেই শিখিয়ে আসছেন তোমার কাজ বাড়ি সংশ্লিষ্ট, তুমি যাই করো না কেন তোমাকে ঘরে থেকেই সন্তান লালন পালন(পুতুল) করতে হবে।আর ছেলে পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে বিমানের পাইলট হবে। আর পোষাকের বেলায় মেয়ের জন্য থাকবে ঠিলেঠালা, লম্বা ও বড় কাপড়ের পোষাক যা নিয়ে তার স্বাভাবিক চলাফেলা করাই অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অপর পক্ষে পুরুষের জন্য টাইট ফিটিং যথা সম্ভব ছোট পোষাক। এর পেছনেও একটা মেসেজ আছে আর তা হলো নারীর শরীর হলো অনাকাঙ্খিত ও লজ্জাকর জিনিস । আর কে না জানে অনাকাঙ্খিত এবং লজ্জাকর জিনিসপত্র সব ঢেকেই রাখতে হয়।

জীবনের প্রতিটি স্তর থরে থরে সাজানো আছে পুরুষের নিজস্ব কাঠামোতে। নারী যদি এই শিকল থেকে মুক্তির পথও খোঁজে সে কোনোদিনই এই বিশাল অন্ধকার ঘরের দরজা খুঁজে পাবে না। একটা বন্ধ জানালা খুলবে তো আর একটা বন্ধ জানালার মুখোমুখি হবে। লোহার গারদের সেই জানালা খুলতে গিয়ে দেখবে আগের খোলা জানালাটা হয়ত আবার বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই পথ খোলা এবং বন্ধ রাখতে নারীরাই সবার আগে পুরুষের হাতিয়ার হয়ে সামনে আসে। সেই শিশুমন থেকে যে নারীকে পুরুষ তার নিজস্ব গোঁলকধাধায় বন্ধি করে রেখেছে চাইলেই কি তা থেকে মুক্তি মেলে?

টপিক ছিল ওড়না। আর সেই ওড়নার কথা বলতে গিয়ে সাতকাহন গেয়ে ফেললাম। আমরা যারা “ও তে ওড়না পড়তে চাই” বাক্যটি দেখে আঁতকে ওঠার ভান করছি তারা কি জানি না এও নারীর শিকলকে আরও পোক্ত করার আর একটি ধাপ যার পিছনে রয়েছে ধর্মের আফিম।যে ধর্মও পুরুষের একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি। এখন থেকে আপনার আমার সন্তানেরা শিখবে সত্যিই তবে নারী দেহ অনাকাঙ্খিত এবং লজ্জাকর কারণ এবং তাকে ঢেকে রাখাই শ্রেয়। সেই সাথে এও শিখবে, সে নারী হয়ে জন্মেছে তাই তার নিজের শরীরের উপরও তার নিজস্ব অধিকারটুকু নাই। আর যার নিজের শরীরের উপরই অধিকার নাই সেই শিশু বড় হয়ে অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে? ব্যাপারটা একটু বেশি মাত্রায় হাস্যকর হয়ে গেলো না?

সন্তানেরা তাদের জীবনের প্রথমভাগে যা শেখে বিশেষ করে পাঠ্যবইয়ে তা তারা বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করে এবং তার প্রভাব সারা জীবনই তার উপরে থাকে। সন্তানের পিতামাতা হয়ত সন্তানকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষাই দিতেন কিন্তু বাবারা বাবা হওয়ার আগেও এক একজন পুরুষ। মেয়ের স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠা কিংবা মেয়ের উপর আরোপিত কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিষয়গুলো চিন্তা করার আগে সে পুরুষের আধিপত্যকেই প্রাধান্য দেবে কারণ দিন শেষে সেও একজন পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবী বাচিয়ে রাখার কিছু দায়ভার তার নিজের উপরেও বর্তায়। কিন্তু মায়ের বেলায়? মা যে সেই বাবারই একজন দাষী বৈ সঙ্গী কখনো হতে পারিনি সে মুখ খুলবে কি করে?

একটা সময় ছিল যখন নারীর লেখনী শক্তিকে রুদ্ধ করা হতো। একজন নারী হয়ে গল্প, কবিতা, ইতিহাস লিখবেন কিংবা চিত্রকলায় অমর একটা স্কেচ আঁকবেন এটা প্রায় অকল্পনীয় ছিল। দুচারজন যদিওবা টুকটাক লেখালেখি করত সেগুলোকে প্রকাশ করার কথা চিন্তাও করতে পারত না। তার সেজন্যই হয়ত এমিলি ডিকিনসনের প্রায় হাজারখানেক কবিতা আবিষ্কার করতে হয় তার মৃত্যুর পর তার বিছানার নিচ থেকে আর তখনই প্রথম জানা যায় তিনি একজন কবি ছিলেন।

সুখের কথা আজ মেয়েরাও শিল্পকলায় নিজেদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে এবং লেখালেখিতেও প্রায় সমান দাপট দেখাচ্ছে। কিন্তু তাদের লেখায় নিজে কতটুকু স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন? বা যতটুকুই হয়েছেন ততটুকু কি পুরুষ আধিপত্য ছাপিয়ে নিজেকে প্রতিষ্টিত করার জন্য যথেষ্ট? যদি না হয় তাহলে পুরুষের প্রতিষ্ঠিত হিংহাসনের পুরুষের পাশে যায়গা করে নেয়াটা খুব সহজ হবে না বলে অনুমেয়।

পুরুষের সিংহাসনের পাশের যায়গাটা তো দূরের কথা নারীরা তাদের নিজের শরীরের জয়গানও কি আজ অব্দি গাইতে পেরেছেন? মায়াবতী, স্নেহময়ী কিংবা মমতাময়ীর মতো কোমল স্কেচ অংকন করতে একজন নারী শিল্পীও যখন একজন নারীকেই মডেল হিসেবে বেছে নেন তখন পুরুষরেরা হয়ত বিজয়ের সুখে একটু মুচকি হাসিও হাসেন বৈকি। পুরুষতন্ত্রের সচেয়ে বড় অস্ত্র পুরুষাঙ্গ যার জোরেই আজ পুরুষের এত উচ্চ লম্ফন। নারীও কি কিছুই নেই? থাকলে তো তাকেই তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।।সেই প্রতিষ্ঠা নিশ্চয়ই একজন পুরুষ এসে করে দিয়ে যাবে না? নারীর নিজের কথা, নিজের শরীরের স্বাধীনতার কথা তাকেই যে বলতে হবে।

ফ্রেন্স নারীবাদি Helene Cixcous এর ভাষায় " Women must write herself: must write about women and bring women to writing from which they have been driven away as violently as from their body"
তাই শুধু এইটুকুই বলব একজন নারী হয়ে ওড়না চাইবেন কি চাইবেন না সেই সিদ্ধান্তটা অন্তত নিতে শিখুন। নিজের শরীর এবং নিজস্বতা নিয়ে জয়গান গাওয়ার মাঝে সুখ বৈ লজ্জা তো নাই!

ছবি
সেকশনঃ সাম্প্রতিক বিষয়
লিখেছেনঃ রাশেদুজ্জামান কানন তারিখঃ 08/01/2017
সর্বমোট 7263 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন